সংযমের ঈদ, ধৈর্যের ঈদ, ত্যাগের ঈদ

<<< ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী >>>

একমাস সিয়াম সাধনার পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ্ ঈদ-উল-ফিতরের দিনটি মুসলমানদের উপহার দিয়েছেন।  তাই এই দিন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্যে সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন।  মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঈদের দিন- ‌‘তাকাব্বাল আল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (যার অর্থঃ আল্লাহ আমাদের এবং তোমাদের সৎকর্মগুলো কবুল করুন) বাক্যটি ব্যবহার করে তাঁর সাহাবীদের অভ্যর্থনা জানাতেন।  এ সুন্নাহ্ অনুসরণ করে ঈদের দিন সবাই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখী, গুণগ্রাহী সবাইকে নিজ নিজ আয়োজনে অভ্যর্থনা জানিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে আসছেন।  যেখানে সকল অতিথিকে রকমারী আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা রাখে সবাই।
ঈদ মানেই আপ্যায়ন ও শুভেচ্ছা বিনিময়কে সামনে রেখে চাঁদ রাতে সাজ সাজ রব।  মেয়েদের অনেক ব্যস্ততা।  একদিকে রান্নার প্রস্তুতি। অন্যদিকে মেহেদী পড়া, সাজসজ্জা, ঘর সাজানো ইত্যাদির প্রস্তুতি।  সাথে ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গানটি শুনতে শুনতে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়া, কাজ করতে করতে গুন-গুন করে সেই গানের সুর তোলা।  ভোরে ভোরে রান্না শেষ করা।  সকালে গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পড়া।  আঁতরের সুগন্ধী মেখে ঈদগাহে নামাজ আদায়, মুরব্বীদের কবর জিয়ারত, কোলাকুলি, শুভেচ্ছা বিনিময়, বাসায় ফিরে একসাথে খাওয়া-দাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন, বেড়াতে যাওয়া আরো কত কি!  সব মিলিয়ে চারিদিকে ঈদের আনন্দ সকল জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, আনন্দের খুশবুতে চারিদিকে ম’ম করে।  দিনটি এক অন্যরকম আনন্দে ছেয়ে থাকে- ‘ঈদ মুবারক’ (যার অর্থ: কল্যাণময় হোক আনন্দ উদযাপন) শব্দমালায় মুখরিত হতে থাকে দিনটি।  এমনই এক আনন্দের দিন আজ গৃহবন্দী।
করোনা ভাইরাস মহামারিতে আজ মানবকুল দিশেহারা।  ঘরে-বাইরে সব জায়গায় আজ মানুষ শংকিত।  মহামারিতে বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৫১৪ জন।  সে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের ৪৮০ জন।  সমগ্র বিশ্বে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯৬ জন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ৩৩ হাজার ৬১০ জন।  প্রতিদিন পরিচিত কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন।  চারিদিকে শোক আর আতংকের ছায়া- আনন্দ নির্বাসনে গেছে।  স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটেছে।
নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে বাঁচানোর তাগিদে প্রায় সবাই গৃহবন্দী।  সংযমের পরিচয় দিচ্ছে, ধৈর্য ধারণ করে আছে প্রায় সবাই।  গৃহবন্দী অবস্থায় নিজের আনন্দ বিসর্জন দিয়েছে- পরিবার, সমাজ আর দেশের প্রয়োজনে।  তাই এবারের ঈদে পড়বে না কেউ নতুন জামা-কাপড়, হবে না কোলাকুলি, হবে না বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়, কোনো ঘরে থাকবে না অতিথি অভ্যর্থনার আয়োজন, হবে না কোনো আপ্যায়ন।  এ কারণে চাঁদরাতে নেই কোনো ব্যস্ততা, নেই কোনো সাজ-সাজ রব।  গান আসছে না কারো গলা দিয়ে।  বারে বারে হাত ধোয়ার তাগিদে- কারো নেই মেহেদী পড়ার আয়োজন।  এমন অলস আর বিষন্ন চাঁদরাত কেউ কি কখনও দেখেছে?
দিনটিকে সেলিব্রেট করার জন্যে এ সামাজিক অনুষ্ঠানটি এবারে পরিণত হবে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে।  নিজেদের জন্যই ক্ষুদ্র আয়োজন হবে ঈদের সকালে।  শুভেচ্ছা বিনিময় সীমিত থাকবে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে।  করোনাকালে গৃহবন্দী অবস্থায় এ তো আনন্দের ঈদ নয়।  এটি সংযমের ঈদ, ধৈর্য ধারণের ঈদ, আনন্দকে ত্যাগ করার ঈদ, সহমর্মী/সমব্যাথী হওয়ার ঈদ।  এ এক অন্যরকম ঈদ!  কল্পনাতেও কেউ কি কখনও ভেবেছিল মানবজাতি এমন ঈদ তার জীবদ্দশায় দেখবে?
সকল সংযম, ধৈর্য ও ত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবী থেকে নির্মূল হোক করোনা ভাইরাস।  আল্লাহ্ সমগ্র মানবজাতির এ সংযম, ধৈর্য ও ত্যাগের বিনিময়ে তাদের ক্ষমা করুন, করোনা ভাইরাসের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করুন, পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে দিন।  ঈদের রাত দোয়া কবুলের রাত।  আল্লাহ্ মানবজাতির ওপর রহম করুন, দয়া করুন। আমিন।
সবাইকে ঈদ মোবারক।  সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

লেখক : যুগ্ম সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের সচিব)।

ডিসি/এসআইকে/আইএস/ডিএনকেসি