উত্তর কাট্টলী : হত্যা মামলার বাদিনীকে বের করে দিতে বাড়িওয়ালাকে হুমকির অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে

নগর প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
গত ২৮ জুলাই উত্তর কাট্টলীতে গলায় ফাঁস লাগানো এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে আকবরশাহ থানা পুলিশ। এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা- নিহত যুবক শহীদুর রহমান রনির (২৮) পরিবারের এমন দাবির প্রেক্ষিতে পরেরদিন ভোরে এই ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দা আমানত উল্লাহ শাহ পাড়ার জব্বার আলী সারেং বাড়ির বদিউল আলম প্রকাশ লেদু মিয়ার ছেলে মো. শহীদ, তার ভাগিনা একই বাড়ির রিনা বেগমের ছেলে তানজিন, ফতেহ আহমেদ চৌধুরীর নতুন বাড়ির মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. শহীদ প্রকাশ মেম্বার শহীদ এবং আব্দুল জলিল মিস্ত্রী বাড়ির মৃত সিদ্দিকের ছেলে আকবরশাহ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল সিদ্দীক প্রকাশ মেন্টাল জুয়েলকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।  মামলায় আরো ৪ জনের নাম সন্দেহের তালিকায় উল্লেখ করা হয়।  মামলাটি দায়ের করেন নিহত যুবকের ছোট বোন রেশমী আক্তার (২১)।
মামলা করার পর থেকেই নানানভাবে রেশমীকে খারাপ সাব্যস্ত করতে এলাকায় নানান কুৎসা রটানো, আসা-যাওয়ার পথে খারাপ অঙ্গভঙ্গি করে ক্ষেপানো, এসিড মারা, তুলে নিয়ে যাওয়া, রেশমীর পরিবার কোথায় যাচ্ছে তা ফলো করা, রাতের বেলায় ঘরের গেইটে দীর্ঘক্ষণ শব্দ করে ভয় দেখানো ও মামলা তুলে নেয়াসহ নানানভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে বলে জানায় রেশমী।  সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) ও আজ বুধবার (১২ আগস্ট) রেশমীদের বাড়িওয়ালা মো. কামালকে ডেকে নিয়ে রেশমীরে পরিবারকে ঘর থেকে বের করে দিতে চাপ দেয়া হয়।  যদি বাড়িওয়ালা রেশমীকে বাড়ি থেকে বের না করে তাহলে মিথ্যা মামলা, ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন ভয় দেখানো হয়।  সরাসরি কামালকে মোবাইলে ফোন করে দলীয় অফিসে ডেকে নিয়ে এসব হুমকি দেন থানা আওয়ামী লীগের এক পদবীধারী নেতা।  উত্তর কাট্টলীতে এই নেতাকে নিয়ে নানান অপকর্ম-অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, বিচার-শালিসের নামে টাকার বিনিময়ে অন্যায়ভাবে বিচারপ্রার্থীকে থামিয়ে দেয়া, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ভুয়া সংগঠন গঠনের মাধ্যমে, সরকারি জমি দখল করিয়ে দেয়া, বিভিন্ন অপরাধীর হয়ে সুপারিশ, দালালি করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।  স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও তার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন দলের নাম ভাঙিয়ে তার এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে।
রেশমী আক্তার, তার পরিবার ও স্থানীয় অনেকে দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, উত্তর কাট্টলীতে দীর্ঘদিন ধরে উত্যক্তের শিকার হচ্ছেন রেশমী আক্তার (২১)।  ২০১৬ সাল থেকে রেশমীকে পর্যায়ক্রমে এলাকার মেম্বার শহিদ, গুটি শহীদ, ছাত্রলীগ নেতা মেন্টাল জুয়েল ও তাদের সহযোগিরা নানানভাবে কু-প্রস্তাব, আসা-যাওয়ার পথে উত্যক্ত করা এমনকি গায়ে হাত দেয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে।  নানান সময়ে রেশমিকে তুলে নেয়ার হুমকি, একদিনের জন্য হলেও বিয়ে করে তেজ মেটানোর হুমকি, এসিড মারার হুমকিসহ নানানভাবে তাকে হয়রানি করছিল তারা।  শুধু রেশমী নয় এলাকার গরীব ঘরের অনেক মেয়েদের সাথেই তারা এমন করে।  রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সব সময় মানুষদের হয়রানি ও নির্যাতন চালায়।  রেশমীকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করার কারণে নানানভাবে তারা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো।  এসব কারণে রেশমী ২০১৬ সালে মেম্বার শহীদের বিরুদ্ধে থানায় প্রথম জিডি করেন।  কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।  রেশমীকে দুর্বল করতে এলাকায় তার বিরুদ্ধে নানান কুৎসা রটানো হতো।  এমন কাজ অন্য মেয়েদের বেলায়ও করা হতো।  অভিযোগ করলে কোনো ফল পাওয়া যেতো না।  এসব কারণে অনেক মেয়ে এলাকা ছেড়েছে।  অনেকে এখনো এলাকায় থাকলেও পরিস্থিতির কারণে এবং আসামিরা প্রভাব বিস্তার করার ফলে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
বাড়িওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতার হুমকি প্রসঙ্গে রেশমী আক্তার দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, মামলা করার পর থেকেই আমাদের নানানভাবে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়া হচ্ছে।  এ পর্যন্ত আমাকে আরেকটা লাশ ফেলা, এসিড মারা, খারাপ অঙ্গভঙ্গি করে আমাদের বিরক্ত করা, আমরা কোথায় যাচ্ছি তা জানতে পেছন নেয়া, রাতের বেলায় আমাদের ঘরের গেইটে জোড়ে শব্দ তৈরি করে ভয় দেখানো এমনকি রাতে বাইরে থেকে তালা দিয়ে আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে।  সর্বশেষ মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) ও আজ বুধবার (১২ আগস্ট) আমাদের বাড়িওয়ালা কামাল আঙ্কেলকে ডেকে নিয়ে এক আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের যাতে ঘর থেকে বের করে দেয় সেজন্য কামাল আঙ্কেলকে চাপ দেয়।  যদি না করে তাহলে উনাকে (বাড়িওয়ালাকে) নানান ঝামেলায় পড়তে হবে বলেও হুমকি দেন।  বিষয়টি আমি থানার ওসি স্যারকে (মোস্তাফিজুর রহমান) থানায় গিয়ে জানিয়েছি।  এর আগে আগের ঘটনাগুলোও জানিয়েছি।  উনি আমাদের বাড়িওয়ালাকে অভয় দিয়েছেন।  কেউ ভয় দেখালে জানাতে বলেছেন।  কিন্তু থানা থেকে আসার পরও আজ (বুধবার) বিকেলে আবারও আমাদের বাড়িওয়ালাকে আওয়ামী লীগ অফিসে যেতে বলেন ওই আওয়ামী লীগ নেতা।  ডেকে নিয়ে আবারও উনাকে ভয় ও হুমকি দেয়া হয়।  তিনি (আওয়ামী লীগ নেতা) টাকার বিনিময়ে এসব করেন বলে এলাকাবাসী জানেন।  রেশমা বলেন, এমনিতেও আমরা যেখানে আছি সেখানে আমাদের ভয় হয়।  মামলার পর থেকেতো আরো ভয়ে আছি।  পাঁচ বছর ধরে আমরা ওখানে আছি।  মামলার পর থেকে আমরাও মনে মনে এখান থেকে বের হয়ে আরো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম।  যাতে আমাদের এতো ভয় না লাগে।  এখন রাতে ঘুম হয় না।  এতোদিন আসামিরা ভয় দেখাতো, এখন এলাকার বড় নেতাও প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন।  জানি না কি করবো।

রেশমীর বাড়িওয়ালা মো. কামাল মুঠোফোনে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। দৈনিক চট্টগ্রামকে তিনি জানান, আমাকে ……. ভাই ডেকেছেন। গতকালকেও ডেকে নিয়ে বলেছেন, রেশমীর বিষয়ে সমস্যা, অনেক অভিযোগ আছে, তাদেরকে যেনো আমি ঘড় ছেড়ে দিতে বলি।  ওরা অনেক বছর আমার এখানে।  আমি এখনো ….. ভাইয়ের সামনে আছি।  উনার সাথে কথা বলবেন (প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে)?  তিনি বলেন, থানার ওসি স্যার বলেছেন এমন কিছু হলে বা রেশমীদের বের করে দিতে কেউ চাপ দিলে উনাকে জানাতে।  কিন্তু এখনতো আবার আমাকে আওয়ামী লীগ নেতা ……… অফিসে ডেকেছেন।  আমি এখন উনার সামনে আছি।

উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, যেহেতু এটি একটি খুনের মামলা হিসেবে থানায় রেকর্ড হয়েছে, সেহেতু এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কাউকে দায়িত্ব দেয়নি।  যেহেতু এটি তদন্তাধীন, অপরাধী যেই হোক আইনী প্রক্রিয়ায় সেটি প্রমাণিত হবে।  এভাবে মামলার বাদিকে ঘর থেকে বের করতে বাড়িওয়ালাকে চাপ দেয়ার বিষয়টি খুবই অন্যায়।  এসব বিষয়ে সাথে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ অবগত নয়।  এর আগে গত মার্চে ছাত্রলীগ নেতা জুয়েলের বিরুদ্ধে ভিডিওসহ একটি অভিযোগ পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি ভিডিওটি দেখেছি।  আমিতো তখন ন্যায় বিচার করে দিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, এটি আইনী পর্যায়ে চলে গেছে অর্থাৎ খুনের মামলা।  কাজেই এটি মিমাংসা করার জন্য কিংবা এই বিষয়ে কিছু করার জন্য আমরা কাউকেই দায়িত্ব দেইনি।  কেউ যদি নিজের এলাকার ভেবে করে থাকে সেটি ওই ব্যক্তির দায়।  সংগঠন এখানে কোনো দায়-দায়িত্ব নিবে না। 
আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, দুপুরে মামলার বাদি রেশমী থানায় এসে আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন।  আমি বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেছি।  মামলার বাদিকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালার উপর কেউ চাপ সৃষ্টি করলে আমাকে জানাতে বলেছি।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ