বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘সদস্য’ পদে প্রথম নারী ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী

সুমাইয়া সীমু, নগর প্রতিবেদক >>>
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ চা-বোর্ড এর ‘সদস্য’ পদে নিযুক্ত হয়েছেন ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।  দেশের ইতিহাসে তিনিই এই পদে প্রথম নারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেন।  তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব এবং বিসিএস (প্রশাসন)- পঞ্চদশ ব্যাচের কর্মকর্তা।  ইতোপূর্বে আরো কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।  এখন পর্যন্ত যে পদসমূহে দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলোতেও প্রথম নারী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।  এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সমাজসেবা অধিদফতর, চট্টগ্রাম বিভাগের ‘বিভাগীয় পরিচালক ও অফিস প্রধান’ এবং বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, চট্টগ্রাম বিভাগের ‘বিভাগীয় উপ-পরিচালক ও অফিস প্রধান’।  উভয় পদে বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবেও তিনিই প্রথম দায়িত্ব পালন করেছেন।  কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ চা-বোর্ড এর ‘সদস্য’ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের আগে পরিবেশ, বন এবং জলবায়ূ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের স্থায়ী অফিসের ‘সচিব’ পদে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম বিসিএস কর্মকর্তাও তিনি।
উল্লেখ্য, এ পদটি বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ।  যে পদে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম নারীও তিনি।  দীর্ঘ ২৪ বছরের চাকুরি জীবনে ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।  তিনি চাকুরী জীবন শুরু করেন মাঠ পর্যায়ে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।  তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।  পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার এবং সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করেছেন।  দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অর্থ বিভাগে এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন।  এছাড়াও, তিনি বিদেশে কূটনীতিবিদ হিসেবে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ‘প্রথম সচিব (ইকনমিক) এবং অর্থনৈতিক উইং এর প্রধান’ হিসেবে কাজ করেছেন।  উক্ত পদেও প্রথম নারী তিনি এবং এ পদে তিনি বাংলাদেশ-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন; বাংলাদেশ-বেলজিয়াম ও বাংলাদেশ-লুক্সেমবার্গ এর ‘অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা’র সকল কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।  উল্লেখ্য, তিনি বিভিন্নভাবে ‘ভ্যালু-এড’ করে তাঁর প্রতিটি কর্মস্থলকে তাঁর মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে পড়াশোনা করেছেন।  তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় মিশনারী স্কুলে- চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাস্টিকায়।  এরপর চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়- অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ANU)’তে তিনি পড়াশোনা করেন।
শিশুকাল থেকেই ড. নাজনীন মেধার ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।  তিনি চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাস্টিকা থেকে এসএসসি, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ হতে এইচএসসি শেষ করেন এবং উভয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে প্রথম বিভাগে পাশ করেন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথমস্থান এবং অনার্সে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।  পরবর্তীতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্যে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি ANU হতে অর্থনীতিতে তিনটি উচ্চতর ডিগ্রি- পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা, এমএস ও পিএইচডি লাভ করেন।  উল্লেখ্য, তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ও এমএস ডিগ্রিতে ‘Distinction’ লাভ করে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে পিএইচডি’র অফার পান।  আরো উল্লেখ্য, তিনি উচ্চশিক্ষার জন্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান সরকার হতে তিনটি বৃত্তি (অস্ট্রেলিয়ান লীডারশীপ অ্যাওয়ার্ড স্কলারশীপ, অস্ট্রেলিয়ান এন্ডেভার পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড স্কলারশীপ ও অস্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট স্কলারশীপ) এবং ANU হতে একটিগ্র্যান্ট (ক্রফোর্ড গ্র্যান্ট) লাভ করেন।

স্বামী ডা. জিয়াউল আনসার চৌধুরীর সাথে ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

ড. নাজনীন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও সুনাম অর্জন করেছেন।  অস্ট্রেলিয়ায় অর্থনীতিতে তাঁর পিএইচডি-গবেষণার মূল ফোকাস ছিল ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা’।  তাঁর পিএইচডি গবেষণার কেইসস্টাডি ছিল নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ তথা সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা-যেটি ব্লু-ইকোনোমি হিসেবে পরিচিত।  উল্লেখ্য, ব্লু-ইকোনোমির ওপর সারা পৃথিবীতে এখনও গবেষণার সংখ্যা খুবই হাতেগোনা।  ড. নাজনীনের পিএইচডি’র থিসিস অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অনলাইন রিসার্স লাইব্রেরি’তে রয়েছে।  তিনি তাঁর পিএইচডি’র গবেষণার বিভিন্ন পেপার অস্ট্রেলিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড রিসোর্স ইকোনোমিক্স সোসাইটি (AARES)-এর বার্ষিক সম্মেলনে এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্রফোর্ড স্কুলের বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপন করেন।  আন্তর্জাতিক জার্নাল ইকোনোমিক বুলেটিনে তাঁর গবেষণা পেপার প্রকাশিত হয়েছে।  তাঁর বেশক’টি গবেষণা পেপার অর্থনীতি বিষয়ের বিভিন্ন পিয়ার-রিভিউড আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের জন্যে অপেক্ষায় রয়েছে।  ড. নাজনীন বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ANU’র অস্ট্রেলিয়া-জাপান রিসার্চ সেন্টার এর অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা মূল্যায়ন সংক্রান্ত গবেষণা প্রকল্পে গবেষণা সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছেন।  তিনি ANU’র ক্রফোর্ড স্কুল অফ ইকোনোমিক্স এন্ড গভর্মেন্ট হতে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার কার্যপত্র ও সম্মেলনে উপস্থাপনযোগ্য বিভিন্ন গবেষণাপত্রের রিভিউয়ার হিসেবেও কাজ করেছেন।  তিনি ২০১০ সাল হতে আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল অস্ট্রেলিয়ান জার্নাল অফ এগ্রিকালচার এন্ড রিসোর্স ইকোনোমিক্স- এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করছেন।  অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে তিনি অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি উইং- এ গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।  সেখানে তিনি যে গবেষণাগুলো করেছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- বিদ্যুৎ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।  বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে এটি ছিল প্রথম কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চ এবং তাঁর এ গবেষণার প্রায় সব ফলাফল সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতিমালায় সংযোজিত হয়েছে।  তিনি অর্থ বিভাগের মূল্যস্ফীতি ও লেনদেন ভারসাম্য’সহ আরো বেশ কিছু কনসেপ্ট পেপার প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  সামগ্রিক অর্থনীতির চার সেক্টরের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ বিশ্লেষণে অর্থ বিভাগের কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় যে কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়ে থাকে- সেটি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের আদলে বিশ্লেষণ ও আধুনিকায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।  তাছাড়া, বাজেট রিফর্মের অংশ হিসেবে মধ্যমেয়াদী বাজেট কৌশলপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনে তিনি ভূমিকা রাখেন।

নিজ জন্মস্থান উত্তর কাট্টলীতে স্থানীয় কাট্টলী বার্তা’র অনুষ্ঠানে ড. নাজনীন কাউসার।

ড. নাজনীন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসেবেও বিভিন্ন সময় বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি ANU’র ক্রফোর্ড স্কুল অফ ইকোনোমিক্স- এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ও এমএস পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন।  ড. নাজনীন বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি, নৈতিকতা ও শুদ্ধাচার, শিষ্টাচার ও প্রটোকল, ই-গভর্নেন্স, আইটি ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষার বিভিন্ন কোর্সে রিসোর্স পার্সন হিসেবে নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকেন।  এছাড়া, তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যে অনুষ্ঠিত বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও অর্থনীতির বিভিন্ন মডিউলের ওপর ক্লাস নিয়েছেন।  তিনি সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বেতার ও টিভি’র বিভিন্ন সেশনে রিসোর্স পার্সন ও প্যানেলিস্ট হিসেবেও অংশগ্রহণ করেছেন।  দেশে-বিদেশে কোর্স শেষে ছাত্র-ছাত্রী ও প্রশিক্ষণার্থীদের মূল্যায়নে তাঁর প্রতিটি ক্লাস/সেশনের বিপরীতে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সব সময় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।  একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রফেশনাল নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন।  তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অর্থনীতি ছাত্র-ছাত্রী সমিতির আজীবন সদস্য এবং অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের বেশক’টি অর্থনীতি সমিতির সদস্য।  একাডেমিক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে তিনি দেশে এবং বিদেশে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন সেসকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অফিসিয়াল এলামনাই এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য।
ড. নাজনীন দেশ ও বিদেশ হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন।  তিনি দেশে সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, আইন ও প্রশাসন, প্রশাসন ও উন্নয়ন, জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আচরণ ও শৃঙ্খলা ও কোষাগার ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিধি-বিধান, ইন্টারনেট ব্যবহার, শিশু অধিকার- এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।  এছাড়া, তিনি বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হতেও বেশ কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজের কর্মদক্ষতার উন্নয়ন করেন।  তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ হতে ৬ মাস মেয়াদী ইংরেজী ভাষার বিশেষায়িত সার্টিফিকেট কোর্স এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল হতে বাণিজ্যিক ইংরেজী কোর্স সম্পন্ন করেন।  অপরদিকে, বিদেশে তিনি অস্ট্রেলিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনালই উনিভার্সিটি হতে তথ্য জ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি এবং গ্র্যাজুয়েট টিচিং প্রোগ্রাম, ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ড হতে দক্ষতা ও উন্নয়নশীলতা এবং ম্যাককুয়ার ইউনিভার্সিটি হতে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়ন এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।  এছাড়া, তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি পুত্রামালয়েশিয়া হতে প্রশাসন ও উন্নয়ন, অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস সাউথ এন্ড ওয়েস্ট এশিয়ার সদর দপ্তর-শ্রীলংকা হতে নেতৃত্বে নারী, আইএমএফ এর আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-সিংগাপুর হতে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠন, অস্ট্রেলিয়ান সরকারের Foreign Affairs & Trade দপ্তর হতে নেতৃত্বের উন্নয়ন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা- সুইজারল্যান্ড হতে স্যানিটারী ও ফাইটো-স্যানিটারী এগ্রিমেন্ট এবং ডেনমার্কের ডানিডা ফেলোশিপ সেন্টার হতে অরগ্যানাইজেশনাল চেইঞ্জ ম্যানেজম্যান্ট এর ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।  উল্লেখ্য, তিনি বিভিন্ন বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্যে আইএমএফ ও ডানিডা হতে দুইটি ফেলোশিপ এবং বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন, বিশ্বব্যাংক এবং ডানিডা হতে বেশ ক’টি গ্র্যান্ট লাভ করেন।

উত্তর কাট্টলীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে ড. নাজনীন কাউসার।

কর্মজীবনে ড. নাজনীন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং প্যানেলিস্ট হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।  যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত Brussels Economic Forum (BEF)Conference এর Sources of Economic Growth সেশন ও The Post-2015 Sustainable Development Agenda: Global, Asian and European Perspectives Conference এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব; বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত European Development Days (EDD) Conference এর Skills for Bangladesh সেশনে প্যানেলিস্ট; থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত Towards Supply Chain Efficiency Conference এবং মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত International Rubber Research and Development Board (IRRDB) এর Annual Meeting ও International Rubber Conference এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ড. নাজনীন দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শিশুকাল থেকে ক্লাস মনিটর হিসেবে তাঁর নেতৃত্বের যাত্রা শুরু।  পরবর্তীতে এর ধারাবাহিকতাক্রমে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন।  সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী এসোসিয়েশনের প্রকাশনা কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন পঞ্চদশ ব্যাচের বিভিন্ন কমিটিতে বিভিন্ন সময়ে সহ-সভাপতি ও কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পঞ্চদশ ব্যাচের সব ক্যাডারের সম্মিলিত ফোরামের নির্বাহী কমিটিতে মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন।  তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনাকালেও অব্যাহত থাকে।  অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর অবস্থানকালে ড. নাজনীন বিভিন্ন লীডারশীপ পজিশনে থেকে ইউনিভার্সিটি ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।  তিনিই প্রথম বাংলাদেশী শিক্ষার্থী যিনি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এন্ড রিসার্চ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (PARSA)-এর প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং জাতীয় পর্যায়ে কাউন্সিল ফর অস্ট্রেলিয়ান পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এসোসিয়েশন (CAPA)-এর উইম্যান অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।  একই সময়ে তিনি প্রথম বাংলাদেশী স্টুডেন্ট হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পোস্ট গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ কাউন্সিল (PRC)- এর সভাপতি হিসেবে এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কাউন্সিল ও ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটিতে স্টুডেন্ট প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।  উক্ত লীডারশীপ পজিশনসমূহে থাকা অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (ABC)-টিভি নিউজ ও রেডিও’তে এবং বাংলা রেডিও ক্যানবেরা’তে তাঁর ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে।  অস্ট্রেলিয়ান সরকারের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ও ওয়েবসাইটে ‘Latest News: Bangladeshi Awardee flies high at ANU’ এবং ‘Success Story’ শিরোনামে তাঁর সাফল্যের বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়েছে।  অস্ট্রেলিয়ান সরকারের দুটি ওয়েবসাইটে যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ান অ্যাওয়ার্ডস এলামনাই স্টোরি’তে তাঁর সাফল্যের বিস্তারিতএবং গ্লোবাল এলামনাই স্টোরি’তে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।  ড. নাজনীন প্রথম বাংলাদেশী যিনি ‘অস্ট্রেলিয়ান লীডারশীপ কনফারেন্স-২০০৭’ এ বক্তব্য রাখেন।  উল্লেখ্য, উক্ত কনফারেন্সে বিশ্বের ৩২টি দেশের ১৮০ জন স্কলারের মধ্যে আয়োজকদের মাধ্যমে যে ৩ জন (বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং কম্বোডিয়া) স্কলারকে নির্বাচন করা হয়- তিনি তাদের একজন।  আরো উল্লেখ্য, ড. নাজনীন প্রথম বাংলাদেশী শিক্ষার্থী যিনি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের আমন্ত্রণে ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল মান্যবর কুইন্টিন ব্রাইস এসি এবং অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় কেভিন রাড এমপি’র সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান।  অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালে বিভিন্ন অবদানের জন্যে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস উইম্যান ইন লীডারশীপ নেটওয়ার্ক- এর ‘দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া’ এবং ‘বাংলাদেশ’- উভয় চ্যাপ্টারের কোর গ্রুপ-এর সদস্য হিসেবে ড. নাজনীনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে বেশ ক’টি পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ভাইস চ্যান্সেলর পুরস্কার, স্টুডেন্ট অ্যাম্বেসেডর পুরস্কার, ভ্যালিডেকটরী পুরস্কার, সুইম এন্ড সারভাইভ- সুইমস্টার পুরস্কার, টার্নার’স কিডস-ম্যাটার টীম মাল্টিকালচারাল পুরস্কার, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিট্যাল টেরিটরি মাল্টিকালচারাল এফেয়ার্স মন্ত্রীর রিকগনিশন, ভোকেশনাল এক্সসেলেন্স পুরস্কার এবং টপটেন প্রফেশনাল লেডী পুরস্কার।  এছাড়া, তিনি চারটি সম্মাননা ও একটি স্বাধীনতা সম্মাননাসহ বাংলা ও ইংরেজী কবিতা আবৃত্তি, বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলায় বেশ ক’টি পুরস্কার ও সার্টিফিকেট অর্জন করেন।
ড. নাজনীনের পিতা ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীর ঐতিহ্যবাহী নাজির বাড়ির জমিদার মরহুম ফয়েজ আলী চৌধুরীর নাতি।  মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী-শিক্ষা বিস্তার, রাজনীতি ও সমাজসেবায় পারিবারিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার হিসাবে তাঁর সমগ্র জীবন মানবসেবায় অতিবাহিত করেছেন এবং এ কারণে তিনি চাটগাঁর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত।  উল্লেখ্য, ড. নাজনীনের পিতা মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি করেছেন এবং বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত এদেশের প্রতিটি জাতীয় আন্দোলন ও সংগ্রামে দেশ ও জাতির জন্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।  যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ।  ‘ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও যাদুঘর’ ঢাকা হতে প্রকাশিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি’ বইটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যে ১৩৭ জন ভাষাসৈনিকের তালিকা রয়েছে- সে তালিকায় মরহুম বদিউল আলম চৌধুরীর নাম এবং বিস্তারিত স্থান পেয়েছে।  এছাড়া, ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ে মরহুম বদিউল আলম চৌধুরীর অবদান, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রাজশাহীতে ডা. শামসুজ্জোহা নিহত হওয়ার পর চট্টগ্রাম হতে যে বিশাল গণমিছিল বের হয় সেটিতে তাঁর নেতৃত্ব দান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে তাঁর সোচ্চার আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের সকল রেকর্ড সে সময়ের স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হয়েছে।  মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের পাশাপাশি তাঁর পূর্বপূরুষের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কাট্টলী অঞ্চলেরও সার্বিক কল্যাণ সাধন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সম্প্রসারণ, খেলাধুলার পরিবেশ সংরক্ষণসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।  ফলে এ অঞ্চলে সবার কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
ড. নাজনীনের মাতা মরহুম লুৎফা সুরাইয়া চৌধুরী কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী ঢেমুশিয়া জমিদার বাড়ির জমিদার মরহুম জামালউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (প্রকাশ মাইজ্জা মিয়া/আহমদমিয়া)’র ৩য় কন্যা। ড. নাজনীন বিবাহিত।  তাঁর স্বামী ডা. জিয়াউল আনসার চৌধুরী বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং বর্তমানে তিনি সিনিয়র কন্সালট্যান্ট হিসেবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ‘নাক-কান-গলা রোগ এবং হেড-নেক সার্জারী’ বিভাগে কর্মরত রয়েছেন।  ড. নাজনীন দু’সন্তানের জননী।  তাঁর বড় সন্তান নাহিয়ান বুশরা চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরা, স্কটল্যান্ড-এ ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ নিয়ে এবং ছোট সন্তান আরিক নাওয়াল চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককুয়ার ইউনিভার্সিটি, সিডনি’তে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞান’ নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

ডিসি/এসআইএকে/এমএসএ