বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক পদে চট্টগ্রামের মেয়ে ড. নাজনীন

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বীউনিক) এর নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রামের সন্তান ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।  দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী, যিনি বীউনিক- এর নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।  ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলীর মেয়ে।  তার বাবা ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী। 
উল্লেখ্য, বীউনিক-এর নির্বাহী পরিচালক পদ’ সহ দেশে ও বিদেশে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্নপদে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম নারী।  উক্ত পদগুলো হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চা বোর্ডের ‘সদস্য ও উইং চীফ (অর্থ ও বাণিজ্য)’; পরিবেশ, বন ও জলবায়ূ পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের ‘সচিব/ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদফতর, চট্টগ্রাম বিভাগের ‘বিভাগীয় পরিচালক ও অফিস প্রধান’ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, চট্টগ্রাম বিভাগের ‘বিভাগীয় উপ-পরিচালক ও অফিস প্রধান’। এছাড়া, কূটনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসেলস, বেলজিয়ামের অর্থনৈতিক উইং এর ‘প্রথম সচিব ও উইং প্রধান’ পদেও দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোনো নারী।

স্বামী ডা. জিয়াউল আনসার চৌধুরীর সাথে ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

ড. নাজনীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব এবং বিসিএস (প্রশাসন)-পঞ্চদশ ব্যাচের কর্মকর্তা।  তিনি সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মাঠ পর্যায়ে চাকুরীজীবন শুরু করেন।  বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তাঁর দীর্ঘ ২৬ বছরের পদচারণায় মাঠ পর্যায়, বিভাগীয় পর্যায় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি কাজ করে তাঁর প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে তাঁর মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
ড. নাজনীন এর শিক্ষা জীবন শুরু হয় মিশনারী স্কুলে চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাস্টিকায়।  তিনি চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাস্টিকা থেকে এসএসসি, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন এবং উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন।  তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।  তিনি মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান এবং অনার্সে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।  পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে তিনি ANU হতে অর্থনীতিতে তিনটি উচ্চতর ডিগ্রী-পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা, এমএসওপিএইচডি লাভ করেন।  উল্লেখ্য, তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ও এমএস- উভয় ডিগ্রীতে ‘Distinction’ লাভ করেন।
ড. নাজনীন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও সুনাম অর্জন করেছেন।  তিনি ANU’র অস্ট্রেলিয়া-জাপান রিসার্চ সেন্টার-এ গবেষণা সহযোগী, ANU’র ক্রফোর্ড স্কুল অব ইকনমিক্স অ্যান্ড গভর্মেন্ট এর বিভিন্ন সম্মেলনে উপস্থাপনযোগ্য গবেষণাপত্রের ‘রিভিউয়ার’, আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল‘ অস্ট্রেলিয়ান জার্নাল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স’-এর ‘ম্যানুস্ক্রিপ্টরিভিউয়ার’ হিসেবে কাজ করেছেন।  অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে তিনি অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি উইং- এ গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।  সেখানে তিনি যে গবেষণাগুলো করেছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- বিদ্যুৎ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।  বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে এটি ছিল প্রথম কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চ এবং তাঁর এ গবেষণার প্রায় সব ফলাফল সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতিমালায় সংযোজিত হয়েছে।  তিনি অর্থ বিভাগের মূল্যস্ফীতি ও লেনদেন ভারসাম্য’ সহ আরো বেশ কিছু কনসেপ্ট পেপার প্রনয়নে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  সামগ্রিক অর্থনীতির চার সেক্টরের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ বিশ্লেষনে অর্থবিভাগের কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভায় যে কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়ে থাকে- সেটি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের আদলে বিশ্লেষন ও আধুনিকায়নে তিনি গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।  তাছাড়া, বাজেট রিফর্মের অংশ হিসেবে মধ্যমেয়াদী বাজেট কৌশলপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে বিশ্লেষনধর্মী উপস্থাপনে তিনি ভূমিকা রাখেন।  একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রফেশনাল নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

নিজ জন্মস্থান উত্তর কাট্টলীতে স্থানীয় কাট্টলী বার্তা’র অনুষ্ঠানে ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

ড. নাজনীন দেশে ও বিদেশে বেশ ক’টি অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা অর্জন করেন।  যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-অস্ট্রেলিয়ান এএবি উইম্যান ইন লীডারশীপ অ্যাওয়ার্ড (সিভিল সার্ভিস ক্যাটাগরী), ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড, স্টুডেন্ট এম্বেসেডর অ্যাওয়ার্ড, ভ্যালিডেকটরী অ্যাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিট্যাল টেরিটরি মাল্টিকালচারাল এফেয়ার্স মন্ত্রীর রিকগনিশন, ভোকেশনাল এক্সসেলেন্স অ্যাওয়ার্ড, টপটেন প্রফেশনাললেডী অ্যাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ান লীডারশীপ অ্যাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ান এন্ডেভারপোস্ট গ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড (declined) এবং অস্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট স্কলারশীপ।  এছাড়া, তিনি-চারটি সম্মাননা ও একটি স্বাধীনতা সম্মাননাসহ বাংলা ও ইংরেজী কবিতা আবৃত্তি, বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় বেশ ক’টি পুরস্কার ও সার্টিফিকেট অর্জন করেন তিনি।
ড. নাজনীনের পিতা ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীর ঐতিহ্যবাহী নাজির বাড়ীর জমিদার মরহুম ফয়েজ আলী চৌধুরীর নাতি।  মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী-শিক্ষা বিস্তার, রাজনীতি ও সমাজসেবায় পারিবারিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর সমগ্র জীবন মানবসেবায় অতিবাহিত করেছেন এবং এ কারণে তিনি চাটগাঁর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবে পরিচিত।
উল্লেখ্য, ড. নাজনীনের পিতা মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী তৎকালীন পাক-প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি করেছেন এবং বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত এদেশের প্রতিটি জাতীয় আন্দোলন ও সংগ্রামে দেশ ও জাতির জন্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।  মরহুম বদিউল আলম চৌধুরী জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের পাশাপাশি তাঁর পূর্বপূরুষের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কাট্টলী অঞ্চলেরও সার্বিক কল্যাণ সাধন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সম্প্রসারণ, খেলাধুলার পরিবেশ সংরক্ষণসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন-ফলে এ অঞ্চলেসবার কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
ড. নাজনীনের মাতা মরহুম লুৎফা সুরাইয়া চৌধুরী কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী ঢেমুশিয়া জমিদার বাড়ী’র জমিদার মরহুম জামালউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (প্রকাশ মাইজ্জা মিয়া/ আহমদমিয়া)’র ৩য় কন্যা।  ড. নাজনীন বিবাহিত।  তাঁর স্বামী অধ্যাপক ডা. জিয়াউল আনসার চৌধুরী ‘নাক-কান-গলা রোগ এবং হেড-নেক সার্জারী’ বিশেষজ্ঞ ও বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তা।  ড. নাজনীন দু’সন্তানের জননী।  তাঁর বড় সন্তান নাহিয়ান বুশরা চৌধুরী এডিনবরা ইউনিভার্সিটি, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাজ্য হতে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ এবং ছোট সন্তান আরিক নাওয়াল চৌধুরী- ম্যাককুয়ার ইউনিভার্সিটি, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া হতে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞান’ এ সম্প্রতি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন।

ডিসি/এসআইকে/সিসি