নগর প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
চট্টগ্রাম নগরে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নাছির, রাজু ও সেলিম। মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) রাত ৮ টার দিকে নগরের জয় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে তারা কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। সার্সন রোডে সিজিএস স্কুলের পাশে আসা মাত্রই সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে সেলিমের পথরোধ করেন এক তরুণী। এ সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্য এক তরুণ সেলিমের বুকে, পেটে ও উরুতে ধারালো ছোরা দিয়ে জখম করেন। এরপর তার মোবাইল ফোন নিয়ে আবারও অটোরিকশাযোগে পালিয়ে যান ওই তরুণ-তরুণী।
জানা গেছে, বগারবিল ও দেওয়ানবাজার এলাকায় বসবাস করে রাকিব, নিপা ও রাশেদ। নিপা গৃহকর্মী হিসেবে একজনের বাসায় কাজ করেন।
রাকিব, নিপা ও রাশেদ একই এলাকায় বড় হওয়ার সুবাদে পরিচিত। তারা প্রেমিক প্রেমিকা পরিচয় দিয়ে নগর এলাকায় বেড়ানোর কথা বলে সিএনজি টেক্সি ভাড়া নেয়। রাশেদ সবসময় টেক্সি ড্রাইভারের পাশে বসে থাকে। রাশেদ এমনভাবে সামনে বসে যাতে ড্রাইভার মনে করে যে, পিছনে বসা দুজনই প্রেমিক প্রেমিকা এবং সামনে আছেন বন্ধু। ঘুরতে ঘুরতে ছিনতাই করার জন্য কোথাও দাঁড়িয়ে অবস্থান করার সময় ছেলে এবং মেয়ে গল্প করার ভান করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে মোবাইল হাতে থাকা একাকী পথচারীকে টার্গেট করে। পরে সুযোগ বুঝে ছুরিকাঘাত করে ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র।
বুধবার (১৮ নভেম্বর) এমন ছিনতাইকারী চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর কোতোয়ালী থানায় ব্রিফিংয়ে সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ এসব তথ্য জানান।
গ্রেফতার ছিনতাইকারী রাকিবুল হাসান প্রকাশ রাকিব (২৫), রূপালী প্রকাশ রূপা প্রকাশ নিপা (২০), মো. আলাউদ্দিন (৫০) ছাড়াও পৃথক একটি ছিনতাইকারী গ্রুপের আরও পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলো- মো. রুবেল (২৮), ফারজানা বেগম (২৬), মো. রাজু প্রকাশ সুমন (২৩), মো. আলামিন (২৮) ও আব্দুল নাইম (২০)। নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানার পৃথক টিম।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন সিএমপির সহকারী কমিশনার (কোতোয়ালী জোন) নোবেল চাকমা, কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন।
গত তিন দিনে চট্টগ্রাম নগরে এরকম অন্তত সাতটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দুটি ঘটনায়ই নগরের কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালিয়ে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৩ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার ছিনতাইকারীদের মধ্যে দুই নারী ও পাঁচ কিশোর রয়েছে।
এদিকে কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় সংঘটিত একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এতে দেখা যায়, আগের ঘটনার মতোই এক তরুণী সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। মোবাইল হাতে এক পথচারী পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ওই তরুণী পথচারীকে সামনে থেকে আগলে ধরতেই তার সঙ্গে থাকা আরেক তরুণ ছোরা দিয়ে পথচারীকে আঘাত করেন। একপর্যায়ে গুরুতর জখম পথচারীর হাত থেকে মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান তারা।
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ জানান, স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ছুরিকাঘাতে আহত যুবককে হাসপাতালে পাঠাই। পরে খোঁজ নিতে গিয়ে ওই সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের হাতে আসে। তিনি বলেন, প্রথমে বিষয়টি দেখে আমাদের কাছে মনে হয়, এটি কোনো নারীঘটিত ঘটনা। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার কৌশল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অপরাধীদের ধরতে অভিযান শুরু করি। অভিযানে গিয়ে প্রথমে ভুক্তভোগীর মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়। যার কাছ থেকে ফোনটি উদ্ধার করা হয়, তাদের দেয়া তথ্যে আমরা একটি গ্রুপকে ধরি। ওই গ্রুপে এক নারীসহ চার পুরুষ সদস্য আছেন। ধারণা করি, ওই ঘটনার সঙ্গে তারাই জড়িত। কিন্তু তদন্ত এগোতে থাকলে আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারি। অর্থাৎ অপরাধের মূল হোতারা তখনও অধরা।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন জানান, গত ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরের গনি বেকারি মোড়ে ছিনতাইয়ের শিকার হন অরবিন্দু দত্ত নামে এক ব্যক্তি। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। গতকাল রাত ৮ টার দিকে নগরের চকবাজারের সার্সন রোড দিয়ে যাওয়ার সময় মো. সেলিম নামে আরও এক ব্যক্তি ছিনতাইয়ের শিকার হন। এ ঘটনায়ও ভুক্তভোগীর বুক, পেট ও উরুতে ছোড়া দিয়ে মারাত্মক যখম করে ছিনতাইকারীরা।
মোহাম্মদ মহসিন বলেন, এ দুটি ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করা হলে ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন ক্রয়কারী শনাক্তের পর প্রথমে নগরের সিরাজউদ্দৌলা রোড থেকে রুবেল ও তার স্ত্রী ফারজানা বেগমকে এবং তাদের দলের আরও তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেন থেকে পাঁচ কিশোর ছিনতাকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, তাদের গ্রেফতারের পরও গতকাল রাত ৮ টার দিকে নগরের চকবাজারের সার্সন রোডে ছিনতাইয়ের শিকার হন মো. সেলিম। এ ঘটনায় বিচলিত হয় পুলিশ। পরে আবারও তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে রাত ৮ টার দিকে নগরের স্টেশন রোড থেকে ছিনতাইকারী রাকিবুল হাসান রাকিব (২৫) ও তার সহযোগী রুপা ওরফে নিপাকে (২০) গ্রেফতার করা হয়।
সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) নোবেল চাকমা জানান, পুলিশি অভিযানে গ্রেফতার রাকিব ও নিপা দুজন বন্ধু। ছিনতাইয়ের সূত্রেই তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এক বছর ধরে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে বেড়াতেন। প্রেমিক-প্রেমিকা পরিচয়ে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিতেন তারা। এরপর শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন নিপা। সুবিধা মতো কাউকে পেলে তাকে টার্গেট করে তিনি সিএনজি থেকে নেমে পড়তেন। এরপর টার্গেট ব্যক্তিকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে আটকে রাখার চেষ্টা করতেন নিপা। এই ফাঁকে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন রাকিব। ভুক্তভোগী মোবাইল ফোন দিতে না চাইলে ছুরিকাঘাত করে ছিনিয়ে নিতেন। নিপা মূলত আগে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। পরে ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে পড়লে সে ছিনতাইয়ে নামে।
কোতোয়ালি থানা কম্পাউন্ডে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে নিপা ও রাকিবের কথা হয়। এ সময় তারা জানান, গত কয়েক দিনে ছুরিকাঘাত করে ও ভয় দেখিয়ে সাতজনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছেন তারা। রাকিব বলেন, ‘ভয় দেখালে কেউ কেউ মোবাইল দিয়ে দেয়। কিন্তু যারা মোবাইল দিতে চায় না তাদের ছুরি দিয়ে খোঁচা দিই’।
নিপা বলেন, ‘ওই ছেলেগুলো (নাছির, রাজু ও সেলিম) রাকিবের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করছিল। তাই তাদের ছুরি মেরে দিয়েছে’।
সহকারী পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা বলেন, রাকিব এক সময় চকবাজার এলাকার ছিঁচকে চোর ছিলেন। প্যারেড মাঠে খেলতে আসা ছেলেদের মোবাইল চুরি করতেন। পরে নিপাদের সঙ্গে মিলে ছিনতাই শুরু করেন রাকিব। কিন্তু নিপা এর আগে তার মামা সুমনের সঙ্গে মিলে নগরীতে অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছেন। নিপার মামা সুমন নগরের মুরাদপুরে এক দারোয়ানকে ছুরিকাঘাত করে জেলে। এরপর থেকে রাকিবের সঙ্গে ছিনতাই শুরু করেন নিপা।
ডিসি/এসআইকে/এমএনএ