আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, নেত্রী সব কথা জানেন না : মেয়র জাহাঙ্গীর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, আল্লাহর পরে আমার নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আছেন। ভেবেছিলাম, যেকোনো বিপদ-আপদে স্মরণ করলে আল্লাহর তরফ থেকে তাকে পাবো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়… (কথা শেষ করেননি)’।
শনিবার (২০ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় গাজীপুর মহানগরের হারিকেন এলাকায় নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিপক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘তারা যেকোনো মূল্যে আমাকে, আমার পরিবারকে এবং আমার সমর্থকদের ক্ষতি করার জন্য বিভিন্নভাবে পাঁয়তারা করছে। তারা কখনও আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে, কখনও আমাকে পরিকল্পিতভাবে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। আমার অস্তিত্বের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জড়িত। গত নির্বাচন থেকে এই পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে’।
মেয়র আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভুল ও আংশিক তথ্য দিয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছিলাম আমার কথা বলার জন্য। করোনার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেখা করে যদি আমার কথাগুলো বলতে পারতাম তাহলে তিনি সঠিক তথ্য জানতেন। উনার কাছে সঠিক তথ্য গেলে আমি সত্য ও ন্যায় বিচার অবশ্যই পেতাম। আমার ভুল হতে পারে, আমি কোনো পাপ ও অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই। আমাকে তিন বছরের জন্য পদ দেওয়া হয়েছে। আমাকে বহিষ্কার করে আমার, আমার পরিবারের এবং আমার অস্তিত্বের মধ্যে আঘাত হানা হয়েছে। সেটা আমি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করবো এই গাজীপুরবাসীর জন্য এবং আমার জন্য আমার ভুল ক্ষমা চাই। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাকে পুনরায় বিবেচনা করেন।
নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি নগরবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছি। আমি রাস্তা করার জন্য আট হাজার বিঘা জায়গা নগরবাসীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। আটশ’ কিলোমিটার রাস্তার কাজ প্রায় সমাপ্তের পথে নিয়ে এসেছি। ৩২ হাজার বাড়িঘর ও দোকানপাট নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেজন্য আমি নগরবাসীর কাছে ক্ষমা চাই। এ রাস্তাগুলো আমার ব্যবহারের জন্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করতে। সেই উদ্যোগে আমি কাজটি শুরু করেছিলাম। আমি মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছিলাম রাস্তার জন্য। রাস্তার জন্য, ঘরবাড়ি ভাঙার জন্য জনগণকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো টাকা দিতে হয়নি। জনগণ আমার কথায়, কাউন্সিলরদের কথায় ও আওয়ামী লীগের কথায় বাড়িঘর, দোকানপাট সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তারা (প্রতিপক্ষ) আমার এ কাজটি সহ্য করতে না পেরে ভিন্ন পথে গেছে’।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘গাজীপুর মহানগরে দুই হাজার ৮শ’ কারখানা রয়েছে। কখনোই কোনো কারখানার মালিকের কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি আমার দল এবং সিটি কর্পোরেশন চালানোর জন্য। কিছু মিথ্যাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেছে, আমরা নাকি ইন্ডাস্ট্রি থেকে টাকাই উঠাই। দ্বিতীয়ত বলেছে, আমরা মানুষের জমি নিয়েছি। এখানে ৫৭টি ওয়ার্ড আছে, কাউন্সিলর, সাধারণ মানুষ, দলের নেতা রয়েছেন। কোনো মানুষ জমি নিয়ে সমস্যায় পড়লে আমরা সমাধান করে দিয়েছি। মানুষের জমি আত্মসাৎ বা অসদ্ব্যবহারে আমরা ছিলাম না। কিন্তু মিথ্যাবাদীরা সেসব তথ্য দিয়েছে। আওয়ামী লীগ হচ্ছে আমার রক্তের মতো। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গার তুলনায় আমরা গাজীপুরে সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী’।
সংবাদ সম্মেলনের সময় তার চারপাশজুড়ে তৃণমূলের অনেক অনুসারী ছিলেন। অনেককে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা গেছে। দল থেকে তার বহিষ্কারাদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। তার অপরাধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।
সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকশ দলীয় নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী নগরীর ছয়দানাস্থ মেয়রের বাসভবনে সামনে জড়ো হতে থাকেন। মেয়রের পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। দুপুর ১ টার দিকে মেয়র নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে ভবনের নিচতলায় নেমে আসেন। এ সময় নেতা-কর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়রও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। ছোট ভাই ও মা জাহাঙ্গীর আলমকে সান্ত্বনা দিয়ে বাসার ওপরে নিয়ে যান। সাংবাদিকদের অনুরোধে আবার বাসার নিচে নেমে এসে তার বহিষ্কার সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মেয়র বলেন, গাজীপুর মহানগরীতে আওয়ামী লীগকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছি। গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করেছি। ২০১৩ সালের পর থেকে কিছু লোক আমাকে মারতে ও বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আমার পেছনে সব সময় লেগেছিল। যারা ঘরের ভেতরে এসে অডিও রেকর্ড করতে পারে তারা মানুষকে হত্যাও করতে পারে। আমার অস্তিত্ব ও প্রাণের মধ্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমার অভিভাবক হিসেবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি মাথা পেতে নেবো। তিনি যদি আমাকে বিনা দোষে কিংবা বিনা কারণে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে বলেন আমি তা করতে রাজি আছি।
মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগ যেন বিবেচনা করে। আমাকে পদ দেওয়া হোক আর না হোক আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে থাকতে চাই। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। অনেকে না বুঝে হয়তো আমার নামে সমালোচনা করতে পারে। আমার অস্তিত্বে প্রধানমন্ত্রী একটি আদর্শের জায়গা, মায়ের স্থান। তিনি যেন আমার বহিষ্কারাদেশ পুনর্বিবেচনা করেন এবং শহর গড়ার জন্য যেন আমাকে সহযোগিতা করেন।
তিনি বলেন, আমাকে যদি মনে হয় গ্রেফতার করবেন বঙ্গবন্ধুর জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য যদি আমার জীবন দিতে হয় আমাকে বলবেন আমি আত্মসমর্পণ করবো। আমার পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করবো না। আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ যেন না দেওয়া হয়। আমার মা আছে, সন্তান আছে, আমার আওয়ামীলীগ আছে, আমার সমর্থিত লোকজন আছে, শহর আছে। আমার শহরের মানুষ যেন কোনোভাবে অপবিত্র না হতে পারে এ জন্য সবার কাছে সহযোগিতা চাইছি।
এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাউন্সিলর মো. রফিকুল ইসলাম, সদস্য কাউন্সিলর আজিজুর রহমান শিরিশ, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান তরুণ, সহ-দপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রুহুল আমীন, কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, মাওলানা মনজুর হোসেন, মহানগর শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক আ. মজিদ বিএসসি, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, মহানগর কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর আ. কাদির মন্ডল, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সুমন আহমেদ শান্ত বাবু, মহানগর মহিলা লীগের সভাপতি সেলিনা ইউনুস, সাধারণ সম্পাদক ফাহিমা আক্তার হোসনা প্রমুখ কাউন্সিলর ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ