‘রোহিঙ্গা নেতার ছেলে’ আ’লীগ নেতা শাহ আলম যা বললেন

কক্সবাজার প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আওয়ামী লীগের আরো বড় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দেয়া সংক্রান্ত দোয়া মাহফিলের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ আলম চৌধুরী প্রকাশ রাজা শাহ আলম।  তিনি বলেছেন, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হওয়ায় তার প্রতিপক্ষ ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ এই কাজ করেছে।
শাহ আলম বলছেন, তার বাবার জন্ম কক্সবাজারের উখিয়ায়।  কক্সবাজারে তার পারিবারিক ভূ-সম্পত্তি ও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।
তবে উখিয়ার সোনারপাড়ার লোকজন জানিয়েছেন, শাহ আলমের পরিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছিল।  শাহ আলমের বাবা নেতা হিসেবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘রাজা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।  কক্সবাজার পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সার্কিট হাউজ এলাকায় শাহ আলমের ১২ তলা বাড়ি রয়েছে।  তিনি সেখানে থাকেন।
সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।  তাতে শাহ আলমকে মিয়ানমারের ‘কাশেম রাজার ছেলে’ উল্লেখ করে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চেয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মসজিদে কয়েকজনকে মিলে দোয়া করতে দেখা যায়।  এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।  তবে তারা কেউ শাহ আলমকে রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেননি।  তবে বিভিন্ন সূত্র এবং বেশকিছু দালিলিক প্রমাণ রয়েছে যেখানে রাজা শাহ আলম একজন রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবেই প্রতীয়মান হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে রাজা শাহ আলম (বৃত্ত চিহ্নিত)।

ভাইরাল হওয়া ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, ‘মসজিদের ভেতরে ১০-১২ জন লোক মোনাজাতে অংশ নিয়ে বলছেন, ‘পালংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বড় এক নেতা এ খতমে কোরআনের আয়োজন করেছেন বার্মার (মিয়ানমার) কাশেম রাজার ছেলে রাজা শাহ আলমের জন্য।  তিনি (শাহ আলম) উখিয়া উপজেলার (আওয়ামী লীগের) সম্মেলনের নেতা হওয়ায় শোকরিয়া আদায়ের জন্য।  তাকে আওয়ামী লীগের বড় নেতা বানানোর জন্য।  ভবিষ্যতে তাকে (শাহ আলম) আরও বড় নেতা বানিয়ে যেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে পাই।  ইসলামের দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজা শাহ আলম যাতে আরও বড় নেতায় পরিণত হন’।
গত সোমবার উখিয়ার পালংখালীর একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মসজিদে এই দোয়া মাহফিল হয় বলে স্থানীয়দের কাছে খবর পাওয়া গেছে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করে জেলা আওয়ামী লীগ।  তাতে শাহ আলমকে আহ্বায়ক করা হয়।  রাজা শাহ আলম বলেন, ওই দোয়া মাহফিল আয়োজনের বিষয়ে কিছু জানা নেই।  আমার বাবার জন্ম এখানে।  আমি রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত না।  এটি আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অপপ্রচার।  মূলত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের অংশ এটা।  তিনি বলেন, ‘যদি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকই হয়ে থাকেন আমার বাবা তাহলে পাকিস্তান আমলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী ও ঢাকায় কিভাবে ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।  চট্টগ্রামে বাড়ি ও হোটেলের মালিক হয়েছেন?  তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনের পর তিনি কিভাবে ব্যবসা করার লাইসেন্স ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?  কক্সবাজারে পর্যটন এলাকায় সরকার হোটেল করার অনুমোদন দিয়েছে কিভাবে?’
শাহ আলম বলেন, ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সদস্য হন তিনি।  জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বের পর এখন সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
যা বলছেন স্থানীয়রা
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনারপাড়ার বাসিন্দা ৮৫ বছর বয়সী জাকের হোসাইন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নেতা আবুল কাশেম ওরফে কাশেম রাজা পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে উখিয়ার সোনারপাড়ায় পরিবারসহ আশ্রয় নেন।  তিনি এখানে অবস্থান করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতেন।  সে সময় কাশেম রাজা মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিতেন।  মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি রোহিঙ্গাদের মাঝে ‘কাশেম রাজা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।  তাছাড়া উখিয়াসহ কক্সবাজারের স্থানীয়রাও তাকে ‘কাশেম রাজা’ নামে চেনেন’।

কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টে রাজা শাহ আলমের ‘হোটেল মিডিয়া’।

তিনি বলেন, ‘১৯৬৭ সালে উখিয়ার সোনারপাড়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে কাশেম রাজা নিহত হন’।  কাশেমের পারিবারিক পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কাশেম রাজার দুই স্ত্রী ছিলেন।  তাদের মধ্যে প্রথম স্ত্রী রোহিঙ্গা নাগরিক এবং দ্বিতীয় স্ত্রী কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বাসিন্দা।  কাশেম রাজার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।  শাহ আলম দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান’।
এলাকাবাসী আরও বলেন, কাশেম ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রথম দিকের নেতা ছিলেন।  তার নেতৃত্বে রোহিঙ্গারা স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখত।  সাহসী ভূমিকার কারণে কাশেম রাজা হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অনেকের মাঝে তিনি এখনও অনুপ্রেরণার অংশ।  মিয়ানমারের গুপ্তচরেরা ১৯৬৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর উখিয়ার ইনানী পাহাড়ি এলাকায় কাশেম রাজাকে হত্যা করে।  এরপর পরিবারের হাল ধরেন রোহিঙ্গা নেতার বড় ছেলে রাজা শাহ আলম প্রকাশ শাহ আলম চৌধুরী।  তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য বাবার মতো সক্রিয় লড়াই করার পরিবর্তে পরিবার গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেন।  শুরু করেন মাছের ব্যবসা।  ধীরে ধীরে ব্যবসায় সফলতার হাত ধরে কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি পর্যটনসেবী আবাসিক হোটেল নির্মাণ করেন।  রাজা শাহ আলম কক্সবাজারে বিভিন্ন ব্যবসার সূত্রে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ বড় নেতাদের সংস্পর্শে চলে আসেন।  এভাবে ২০০৮ সালে কক্সাবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হন।  এক সময় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও হয়ে যান।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শাহ আলম ২০০৭ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।  ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে তিনি ঢাকার ডেমরা থানার একটি এলাকার ঠিকানায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।  পরে তা কক্সবাজারে স্থানান্তর করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ মিয়ানমারের আরাকানের স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা নেতা কাশিম রাজাকে তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাসে’ তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন কাশিম রাজার ছেলে রাজা শাহ আলমের তথ্যও।  বইটির একটি অংশে লেখক লিখেছেন- ‘আরকান ন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন (সুবহান উকিলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি)।  আরকানের মুসলিম যুব সমাজকে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে নৈতিকতা গঠনের নিমিত্তে মোহাম্মদ কাশিম (রাজা শাহ আলমের পিতা) ও মং মং গিয়াই এর নেতৃত্বে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।  রোহিঙ্গা ছাত্রদের মাঝে দ্বীনি চেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে শাহ আলম (রাজা শাহ আলম) ও শাহ লতিফের নেতৃত্বে রেঙ্গুনেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।  উক্ত সংগঠনগুলো ১৯৬৪ সালে নে উইন কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
এভাবে বিত্তবৈভবের মালিক হলেও পিতার আদর্শ ভুলে যাননি শাহ আলম প্রকাশ রাজা শাহ আলম চৌধুরী।  খবর রাখেন জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের।  জনশ্রুতি আছে, যেকোনো সমস্যায় তার কাছে গেলে তিনি বিমুখ করেন না।  বিপন্নরা রোহিঙ্গা হলে খাতির পান একটু বেশি।  কাশেম রাজা সম্পর্কে অবগত রোহিঙ্গারা রাজা শাহ আলমকে নিজেদের ‘আশ্রয়স্থল’ বলে মনে করেন।
স্থানীয় সূত্র মতে, পর্যটন ব্যবসায় সম্পৃক্ততার সূত্রে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে চলে আসেন রাজা শাহ আলম।  যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে সে দলের ক্ষমতাধরদের আস্থাভাজন হিসেবে থেকেছেন।  কোনো দলে তার এককভাবে সম্পৃক্ততার কথা শোনা যেত না।  কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজা শাহ আলম কক্সবাজার সার্কিট হাউস এলাকায় সড়ক লাগোয়া একটি বহুতল ভবন গড়েন।  সেই ভবনেই উখিয়া-টেকনাফের সাবেক বিতর্কিত সাংসদ এবং রোহিঙ্গাদের কাছেরজন হিসেবে পরিচিত আব্দুর রহমান বদি ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপিকে নামমাত্র মূল্যে একটি করে ফ্ল্যাট উপহার দেন।  তখন থেকেই আওয়ামী রাজনীতিতে নাম যুক্ত হয় রাজা শাহ আলমের।  সেবার জেলা কমিটিতে অর্থ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পান তিনি।  বাড়তে থাকে তার প্রতিপত্তি।  বাবার সুবাদে তার বড় ছেলেও জেলা যুবলীগের প্রস্তাবিত কমিটির অর্থ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন।  রাজা শাহ আলম চৌধুরীর ছেলে ইমরান আলম চৌধুরী চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম নগরে প্রতিষ্ঠিত ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের রেজিস্ট্রার।

ডিসি/এসআইকে/এফআর