টেকনাফে ২১ ইয়াবা ব্যবসায়ির আত্মসমর্পণ : ‘কোনোদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি’

কক্সবাজার প্রতিনিধি >>>
‘মাদক ব্যবসা ধরার পর কোনো দিন শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। এমনকি ঈদের নামাজও কখনো পড়ার সুযোগ হয়নি’- নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য জানান টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তৈয়ব প্রকাশ মধু তৈয়ব। আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার জন্য তিনি তাই জেলা পুলিশকে ধন্যবাদ জানান।
পূর্বঘোষিত ঘোষণা অনুসারে কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ করে ২১ ইয়াবা তথা মাদক ব্যবসায়ী। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে টেকনাফ সরকারি ডিগ্রী কলেজ মাঠে তারা আত্মসমর্পণ করে। অনুষ্ঠানে ২১ হাজার পিস ইয়াবা, দেশি ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩০টি গুলিসহ আত্মসমর্পণ করে তারা। এরপর আত্মসমর্পণকারীদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ জন চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের পর এটি ছিল দ্বিতীয় আত্মসমর্পণের ঘটনা।
এই উপলক্ষে জেলা পুলিশের আয়োজনে বিকেলে পৌরসভাস্থ টেকনাফ সরকারি ডিগ্রী কলেজ মাঠে কমিউনিটি পুলিশিং সমাবেশ ও মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ মঞ্চে আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তৈয়ব প্রকাশ মধু তৈয়ব বক্তব্য রাখার সুযোগ পায়। জানা গেছে, শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণ যারা তারা অতীত কর্মের জন্য অনুতপ্ত। আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার শপথ নিয়েছেন। পুনর্বাসনের জন্য তারা সরকারের কাছে আবেদনও জানান। এর আগে সকালে ‘সেফ হোম’ থেকে বাসে করে তাদের টেকনাফে নিয়ে আসা হয়। এ সময় আত্মীয়স্বজন দেখতে ভিড় করেন এবং অনেকে কান্নাও করেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক।
আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়িদের মধ্যে রয়েছেন- টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভী পাড়া এলাকার আবুল কালাম প্রকাশ কালা সওদাগর (৪৯), মো. রিদোয়ান (২২), আব্দুর রাজ্জাক (৩০), আব্দুল আমিন প্রকাশ আবুল (৩৯), বশির আহম্মদ (৪০), মো. রাসেল প্রকাশ হাজী রাসেল (২৯), ফজল করিম (২৬), উত্তর লম্বরী এলাকার মো. তৈয়ব প্রকাশ মধু তৈয়ব (৩৮), মাঠ পাড়া বিজিবি ক্যাম্প এলাকার মো. জাহেদ উল্লাহ (২৪), সাবরাং ইউনিয়নের লেজির পাড়া এলাকার মো. ইদ্রিস (৫৭), খয়রাতি পাড়ার মো. সাদ্দাম (২৭), সিকদার পাড়া এলাকার আব্দুল গফুর (২৬), মো. হোসেন প্রকাশ কালু (২৭), টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরী পাড়ার মো. ইসমাইল (৩১), পুরাতন পল্লান পাড়ার আব্দুল নুর (৩৯), হ্নীলা ইউনিয়নের ফুলের ডেইল এলাকার নূর মোহাম্মদ (২৮), সিকদার পাড়া এলাকার ইমাম হোসেন (৩০), উলুচামারী কোনার পাড়া এলাকার মিজানুর রহমান (২৩), হোয়াইক্যং উত্তর পাড়া এলাকার ফরিদ আলম (৪৮), মহেষখালীয়া পাড়া এলাকার শাহাদত হোসাইন (২৮) ও কক্সবাজারের ঝিলংজা পশ্চিম লারপাড়া এলাকার ইমাম হোসেন (৪৩)।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘প্রতি বছর মাদকের ৫০ হাজার কোটি টাকা মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে। তার বিনিময়ে আসছে মরণ নেশা ইয়াবা। এই ইয়াবা বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যারা ৫০ হাজার কোটি টাকা মিয়ানমারে পাঠাচ্ছে তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। ফিলিপাইনে মাদক রোধে লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তার তুলনায় এখানে খুবই নগন্য’। যারা এখনো আত্মসমর্পণ না করে, মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে ডিআইজি বলেন, জঙ্গি ও দুর্নীতিবাজদের মতো আমরা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এই যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে। কেননা, এ দেশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এই মাটিতে মাদক, জঙ্গি ও দুর্নীতিবাজদের ঠাঁই হবে না। যে কোনো মূল্যে এই ইয়াবা পাচার বন্ধ করতেই হবে। পাশাপাশি মাদক, জঙ্গি ও দুর্নীতি বন্ধ হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই দেশ উন্নত দেশে রুপান্তরিত হবে’।
তিনি বলেন, মাদকের সঙ্গে কোনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদক বন্ধের নাম দিয়ে যদি কোনো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর লোকজন নিরীহ কোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করে সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণকারীরা অতীতের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, তাই তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। ফলে সরকার তাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখবে। আত্মসমর্পণের বাইরে থাকা বাংলাদেশের সব ইয়াবা ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ঘাপটি মেরে থেকে কেউ বেঁচে যাবেন, তা যদি ভাবেন, তাহলে ভুল হবে। আত্মসমর্পণের আওতায় না এলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। যারা আত্মসমর্পণ করছে, তাদের জন্য এক ধরনের ‘বার্তা’ আর যারা এখনও আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের জন্য আরেক ‘বার্তা’র কথা উল্লেখ করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পাওয়ার পর মাদকের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অভিযান শুরু করা হয়। এতে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের হাতে ২৮০ জন মারা গেছে। আমরা আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক বা কোনো স্ত্রী বিধবা হোক তা-চাই না। তিনি বলেন, মানুষের উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, টেকনাফকে ইয়াবামুক্ত করতে চান আপনারা। এ এলাকার গুটিকয়েক মানুষের কারণে সাড়ে তিন লাখ মানুষের দুর্নাম হচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এমন আত্মীয়দের আশ্রয়-প্রশ্রয়কারি রক্ষাকারি কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের এর সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়া দেন তিনি।
সাংবাদিক সাইফুল ইসলামের পরিচালনায় কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের সভাপতিত্বে দ্বিতীয় বারের মতো শর্তসাপেক্ষে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, কমিউনিটি পুলিশিং কক্সবাজার জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট তোফায়েল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ বাহাদুর, পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম, ইউএনও সাইফুল ইসলাম, টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সভাপতি নুরুল হুদা ও মৌলভী কেফায়েত উল্লাহ শফিক প্রমুখ।
                                  কারাগারে ২১ আত্মসমর্পণকারী : পুলিশের ভাষ্য
পুলিশ জানিয়েছে, টেকনাফ মডেল থানার পরির্দশক (তদন্ত) এবিএমএস দোহার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ভোরে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের জাহালিয়া পাড়া মালির-মার ছড়া পাহাড়ি এলাকায় অভিযানে গেলে একদল লোক হাত উঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদের কাছ থেকে ২১ হাজার ইয়াবা, ১০টি অস্ত্র ও ৩০টি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় টেকনাফ মডেল থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে দু’টি মামলা (নং ৬ ও ৭ তারিখ ০৩-০২-২০২০) করা হয়। পরে আত্মসমর্পণকৃত ২১ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একইদিন রাতে আদালতের মাধ্যমে কক্সাবাজার জেলা কারাগারে পাঠানো হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
আত্মসমর্পণকাররি হ্নীলার ইমাম হোসেনের মা লতিফা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে লবণ ব্যবসা করতো। পরে এক-সময় বন্ধুদের সঙ্গে মিলে খারাপ কাজে জড়ায়। পরে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। এরপর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাকে এখানে নিয়ে এসেছে বলে শুনেছি, তাই তাকে দেখতে আসলাম’।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘পুলিশের কঠোর অভিযানে ফলে দ্বিতীয় দফায় ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। আত্মসমর্পণকারিদের মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে, আদালতে মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে’।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৯ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান এ বিশেষ অভিযানে গিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ৫৬ রোহিঙ্গাসহ ২০৯ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী ও ডাকাত-সন্ত্রাসী নিহত হয়। মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত ২১৮ নিহত হয়েছে কক্সবাজার জেলায়।

ডিসি/এসআইকে/এসজেপিআই