লোকালয়ে হাতির চলাচল রোধে সোলার ফেন্সিং নির্মাণের উদ্যোগ

মাহফুজ আলম, কাপ্তাই (রাঙামাটি) প্রতিনিধি >>>
মানুষের প্রাণহানী ও বন্য হাতি হত্যা রোধ এবং হাতির চলাচলের করিডোর নিশ্চিত করণ, লোকালয়ে হাতির চলাচল কমিয়ে আনতে কাপ্তাইয়ের পাহাড় ঘেঁষে ৮ কিলোমিটার সোলার ফেন্সিং প্যানেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ বন বিভাগ।
জানা গেছে, পাহাড়ে বন উজাড়ের ফলে হাতির খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে।  যার কারণে খাদ্যের সন্ধানে প্রায় সময় লোকালয়ে আসতে হয় সংঘবদ্ধ হাতির দলকে।  ফলে হাতি ও মানুষের মধ্যে অপ্রত্যাশিত-অপূরণয় ক্ষতি হচ্ছে।  নতুন এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘বুনো হাতি আর মানুষের দ্বন্ধ’ নিরসন।  এই দ্বন্দ্বে গত ৭-৮ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯ জন মানুষ।  আর প্রতিশোধ পরায়ন মানুষের হাতে ৪ বছরে মারা পড়েছে ৬টি বন্য হাতি।  তাই, হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ‘সোলার ফেন্সিং’ আর ‘জনসচেতনতা’ তৈরি- এই দুই ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করতে চায় দক্ষিণ বন বিভাগ।
জানা গেছে, হাতির চলাচলের পথে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে সহনীয় পর্যায়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহযুক্ত তারের বেড়া দেওয়া হবে।  যাতে স্পর্শে আসলে শক লেগে সরে যাবে হাতি।  কিন্তু হাতির মনো-দৈহিক কোনো ক্ষতি হবে না।  এই কৌশলের নাম ‘সোলার ফেন্সিং’।  দেশে এটিই হতে যাচ্ছে প্রথম কোনো প্রকল্প।  এর সাথে যুক্ত হচ্ছে ‘জনসচেতনতা’ তৈরির কাজ।  এতে বরাদ্দ মিললে আগামি সেপ্টেম্বরেই কাজ শুরু হবে।
এরই মধ্যে রাঙামাটি বনবিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।  বিভাগটি বলছে, ‘হাতি ও মানুষকে নিরাপদ রাখাই হলো প্রধানতম চ্যালেঞ্জ’।
তবে এসব হাতির মৃত্যুর একটি ঘটনাতেও মামলা হয়নি।  স্থানীয়দের মতে, এর বাইরেও আরও হাতি মারা পড়ছে যা বন বিভাগের হিসেবের খাতায় উঠছে না।  এমনকি রাঙামাটি জেলায় কতো সংখ্যক হাতি রয়েছে তার হিসেবও নেই বন বিভাগে।  কেবল সরকারি সহায়তা পাওয়া নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যার পরিসংখ্যান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৫ বছরে ৬টি হাতি মারা পড়েছে।  এরমধ্যে সর্বশেষ গত ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে কাপ্তাইয়ের রাইখালী ডংনালা লম্বাঘোনা পাহাড়ি এলাকায় বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে মারা হয়েছে একটি মা-হাতিকে।  ২০১৬ সালে ১০ এপ্রিল কর্ণফুলী রেঞ্জে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে একটি মা-হাতিকে মারা হয়েছে।  ২০১৫ সালে ২ জুলাই জীবতলী পিকনিক স্পট এলাকায় বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মারা পড়ে মা ও শাবকসহ ২টি হাতি।  ২০১৪ সালে ২২ অক্টোবর শুকনাছড়ি বীটে চোরা শিকারির গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা পড়ে ১টি হাতি।  ২০১২ সালের ৮ জুন কর্ণফুলী রেঞ্জে প্রসবকালীন ১টি মা-হাতি মারা যায়।
আর গত ৮ বছরে জেলায় বুনো হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন।  এর মধ্যে শুধু কাপ্তাই উপজেলাতেই গত ৩ বছরে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।  সর্বশেষ গত ২৮ দিনের ব্যবধানে কাপ্তাই ও লংগদুতে ৩ জনের প্রাণহানী হয়েছে।  এরমধ্যে গত রবিবার লংগদুতে আব্দুল মালেক (৬৫), কাপ্তাইয়ে ৭ মার্চ ১ জন ও ১১ মার্চ কাপ্তাই-আসামবস্তি সড়কের কামাইল্যাছড়ি এলাকায় ঢাকার তেজগাঁও টেক্সটাইল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র অভিষেক পাল (২১) নিহত হয়েছেন।
এর আগে ২০২০ সালে ১ জন নিহত ২ জন আহত হন।  ২০১৯ সালে মার্চ-এপ্রিলে জুমে কাজ করতে গিয়ে ২ মাসের ব্যবধানে ৩ জন নিহত ও আহত হন ৩ কৃষক।  ২০১৮ সালে জীবতলীতে ১ নারী ও ২০১৭ সালে কাপ্তাই নেভীর সৈনিক তৌহিদুর রহমানসহ ২ জন নিহত হন।  এছাড়া ২০১৩ সালে ১, ২০১৪ সালে ৩, ২০১৫ সালে ৪ ও ২০১৬ সালে ২ জন নিহত হন।
রাঙামাটির পাবলাখালী অভয়ারণ্য ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকার হাতির কোনো পরিসংখ্যান নেই বন বিভাগের কাছে।  ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন কাপ্তাই এলাকায় জরিপ চালায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ।  ওই জরিপে ৫৭ টি হাতি আছে বলে জানানো হয়েছে।  তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে জরিপ না চালানোয় হাতির প্রকৃত সংখ্যা অজানাই থেকে গেছে।  তবে স্থানীয় অধিবাসিদের মতে, ওই এলাকায় অন্তত ৬০টির মতো হাতির বিচরণ আছে।
মূলত এশীয় ও আফ্রিকান এই দুই প্রজাতির হাতিই রয়েছে পৃথিবীতে।  এশীয় হাতির প্রজাতিটিই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচরণ করেছে।  এর বৈজ্ঞানিক নাম Elephas maximus।  এদের গড় আয়ু মানুষের মতোই, ৬০ থেকে ৭০ বছর।  ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সেই সন্তান জন্ম দেওয়া শুরু করে হস্তিনী।
বন বিভাগ জানিয়েছে, হাতির করিডোরের মধ্য দিয়েই রাঙামাটি-কাপ্তাই আসামবস্তি ১৮ কিলোমিটার পাঁকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।  নির্বিচারে বন উজার হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়েছে হাতি।  মূলত সহজলভ্য খাবার খেতেই হাতির পাল লোকালয়েও চলে আসছে।  এছাড়া ঘরবাড়ি, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা আর সড়ক নির্মাণ করায় হাতির চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।  এসব আমলে নেয়নি মানুষ।  ফলে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব বাড়ছে।
রাঙামাটির প্রধান বন সংরক্ষক সুবেদার ইসলাম বলেন, ‘হাতি ও মানুষকে নিরাপদ রাখাই হলো এ মুহুর্তে বন বিভাগের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ।  এজন্য সোলার ফেন্সিং ও জনসচেতনতার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।  জরিপ না হওয়ায় হাতির প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি।  তবে স্থানীয়দের মতে এর সংখ্যা ৪০ থেকে ৬০ টির মতো হবে’।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, হাতিকে রক্ষা করতে হলে এর চলার পথ বা করিডোর ও বসতি রক্ষা করতে হবে।  হাতির বিচরণ ক্ষেত্রে মানুষের অবাধ চলাচল বন্ধ করতে হবে।  একই সাথে পশুখাদ্য উপযোগী বাগানও তৈরি করতে হবে।  তবেই হাতি ও মানুষের দ্বন্ধ বন্ধ হবে; রক্ষা পাবে উভয়েরই প্রাণ।  আর সুরক্ষা পাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, ‘জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই বণ্যপ্রাণি সুরক্ষায় কাজ করছে স্থানীয় বন বিভাগ।  ইতোমধ্যেই জনসচেতনতা সভা, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, হাতি চলাচলের পথে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড স্থাপন ও পশুখাদ্য উপযোগী বাগান সৃজনে কাজ করছে বন বিভাগ’।

ডিসি/এসআইকে/এমএ