আগুনে পুড়ছে পাহাড়ের পর পাহাড়

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
পার্বত্য এলাকার সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলো যেন তার সর্বস্ব হারিয়ে ফেলছে।  পাহাড়গুলোর গায়ে থাকা নানান জাতের গাছ, গুল্ম, লতা-পাতা, পশু-পাখির আশ্রয়স্থল- সবই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।  পাহাড়ের পর পাহাড় দিনে-রাতে আগুনে জ্বলছে।
জানা গেছে, বংশ পরম্পরায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন পাহাড়িরা।  ধান, মরিচ, মারফাসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেন তারা। বাংলা বছরের চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পরবর্তী বছরের জন্য জমি প্রস্তুত করা হয়। এর জন্য ঝোপঝাড় ও আগাছা পরিষ্কার করতে পাহাড়ে আগুন দেয়া হয়। কিন্তু আগুনে পাহাড়ের পর পাহাড় পুড়ে ধ্বংস হচ্ছ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। নষ্ট হয় মাটির গুণাগুণও। ফলে ভূমিধ্বসের শঙ্কা তৈরি হয়।
তবে বেশ কয়েকবছর ধরে জুম চাষের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে সচেতন করতে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফল জুম চাষের স্থানে অনেকেই এখন মিশ্র ফলের চাষ শুরু করেছেন।
জুমিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা শ্রমসাধ্য বিষয়। এজন্য বছরের পর বছর পাহাড়িরা পাহাড়ে ফসল ফলানোর জন্য আগুন দিয়ে জমি পরিষ্কার করে। এরপর বর্ষা মৌসুমে জমি চাষাবাদের উপযোগী করে তোলা হয়।
জুমের আগুনে সবুজ পাহাড়গুলো পোড়ানোর কারণে তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে রাঙামাটিতে। তাই পাহাড়ে পরিবেশসম্মতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃতি ও ইকো ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করা রাইন্যা টুগুনের পরিচালক ললিত সি. চাকমা বলেন, ‘জুমচাষ একটি বৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতি।  আদিকাল থেকে পাহাড়ের মানুষ এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আসছে।  নির্দিষ্ট এলাকা আগুনে পুড়িয়ে চাষাবাদ করলে জুমচাষ কোনোভাবে ক্ষতিকারক নয়।  তবে মাঝে-মধ্যে অসতর্কতার কারণে পাহাড়ের পর পাহাড় পুড়ে যায়। এজন্য অনেকে জুমচাষের বিপক্ষে।  তবে জুমচাষিদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো তারাও এমন শ্রমসাধ্য চাষাবাদ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতো।  দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই নির্ভর করছে জুমচাষের উপকারিতা ও অপকারিতা’।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষ্ণ প্রসাদ মল্লিক বলেন, ‘এবার বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে এখনো জুম চাষ শুরু হয়নি।  আপাতত পাহাড়ে আগুন দিয়ে চাষিরা জমি পরিষ্কারের কাজ করছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘আদি যুগ থেকে চাষিরা জুম চাষ করে আসছে, তাই তো হুট করে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ বন্ধ করা যাবে না।  তবে আমরা তাদেরকে বলেছি, যতদূর সম্ভব মাটিকে বিরক্ত না করে মাটির উর্বরতা নষ্ট না করে জমি পরিষ্কার করার জন্য। এতে চাষাবাদের জন্য মঙ্গলজনক’।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুজ্জামান শাহ জানান, বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বনভূমি বা পাহাড়ে কেউ আগুন দেয়ার অপচেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রতিহত করা হয়।  মূলত জুম চাষিরা পাহাড়ে চাষ করার জন্য আগুন দিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, আগুন দেয়ার ফলে পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি পুড়ে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।  মাটিতে যে সমস্ত উপকারী অণুজীব আছে সেগুলো ধ্বংস হয়।  বন্যপ্রাণির আবাসস্থল ধ্বংস হয়।  প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  ভূমির উর্বরতা ক্ষয় সাধিত হয়। যার ফলে ভূমিধ্বসের শঙ্কা তৈরি হয় এবং বন্যপ্রাণির খাবার সংকট দেখা দেয়। যার ফলে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসে’।
ষাটের দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান জুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) জি এম মোহাম্মদ কবির বলেন, ‘জুম চাষ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব না। যেহেতু এই চাষের ওপর বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী এখনো নির্ভরশীল। এরপরও আগের চেয়ে জুম চাষ অনেকটাই কমেছে। এখন জুম চাষিরা লেবু ও কলাসহ বিভিন্ন মিশ্র ফল চাষের দিকে ঝুঁকছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘জুম নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় চাষিদের সচেতনতায় দীর্ঘসময় ধরে কাজ করে আসছে, যার সুফল আমরা পাচ্ছি। চাষিরাও আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। আমরা চাষিদের বলেছি, যদিও আগুন দিতে হয় তাহলে যতটুকু জমিতে চাষ করা হবে, ততটুকু ফায়ার লাইন করে দিয়ে আলাদা করে দিলে তাহলে পাহাড়ের পর পাহাড় আগুনে পুড়ে যাবে না। এতে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে’।

ডিসি/এসআইকে/এমএ