চসিক : বছরের পর বছর বাড়ে প্রকল্প ব্যয়, বাস্তবে নেই কাজ

রোকসানা রুনা, নগর প্রতিবেদক >>>
প্রায় ৬ বছর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে অনুুমোদন পেলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি আজও।  উদ্যোগ না নিলেও বছরান্তে বেড়ে যায় প্রকল্প ব্যয়, নকশায়ও আসে সংশোধন।  কিন্তু বাস্তবে নেই কাজ।  চট্টগ্রাম নগরের দুঃখখ্যাত জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নগরের বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খননের প্রকল্প গ্রহণ করেছিল ৬ বছর আগে।  সেই প্রকল্পের কোনো কাজ না হলেও ব্যয় হয়েছে বড় অংকের টাকা।  কয়েকবার বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়।  সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্প পরিচালকের ইচ্ছাকৃত গাফেলতির কারণে প্রকল্পটি আটকে আছে ব্যয়ের মধ্যেই।  বাস্তবে কাজের কিছুই হয়নি।
জানা গেছে, প্রকল্পটি শতভাগ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নসহ দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে চসিক।  আগামি সপ্তাহের শুরুতে এই প্রস্তাব পাঠানোর কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী।  এই সংশোধনী অনুমোদন হলে প্রকল্প ব্যয় প্রায় একশ কোটি টাকা বাড়বে বলে জানা গেছে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমদ জানান, প্রকল্পটির মূল কাজ হলো ভূমি অধিগ্রহণ।  কাজটি করছে জেলা প্রশাসন।  আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে।  তবে জেলা প্রশাসন এখনও ভূমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি।  অন্যদিকে, মোট প্রকল্পের ২৫ ভাগ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।  তাই আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবো প্রকল্পটি যাতে শতভাগ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়।

নিজের মেয়াদের শেষদিকে এসে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করেন সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।  সর্বশেষ গত জুন মাসে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়।  ভাগ্যক্রমে করোনা মহামারির অজুহাতে সব প্রকল্পের সাথে এই প্রকল্পটিও এক বছর বাড়তি মেয়াদ পায়।  বাড়তি সময় পেলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।  তাদের মতে, ৩-৪ বছর সময় লাগবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৯৯৫ সালে যে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছিল তাতে তিনটি নতুন খাল খননের প্রস্তাব ছিল।  এর মধ্যে একটি হচ্ছে বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত।  অন্য দু’টি হলো নয়াখাল থেকে শীতলঝর্ণা এবং মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট।  পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।  ২০১৪ সালে নগরের বহদ্দারহাটসহ আশেপাশের প্রধান সড়ক-উপসড়ক এবং তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহে ভয়াবহভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে চসিক বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্ষন্ত নতুন খাল খননের উদ্যোগ নেয়।  এর জন্য সরকার ৩২৬ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় (ভূমি অধিগ্রহণের ২২৪ কোটি টাকাসহ)।  প্রকল্পে ২৪৫ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা সরকার এবং ৮১ কোটি টাকা চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা ছিল।  ২০১৪ সালের ২৪ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল।  তবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট।  ওই সময় প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
জানা গেছে, নতুন খালটি নগরীর বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া দিয়ে পূর্ব বাকলিয়া হয়ে বলির হাটের পাশের কর্ণফুলী নদীতে সংযুক্ত হবে। খালটির দৈর্ঘ্য হবে ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রস্ত হবে ৬৫ ফিট।  খালটির মাটি উত্তোলন, সংস্কার ও সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টির অংশ হিসেবে খালের উভয় পাশে ২০ ফিট করে ২ টি সড়ক ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা ছিল।
প্রকল্প সম্পর্কে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

ভূমি অধিগ্রহণে আটকে থাকা

ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ না করেই মাটি উত্তোলনের মাধ্যমে খাল খনন কাজের উদ্বোধন করেন সদ্য সাবেক মেয়র নাছির।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভূমি অধিগ্রহণ।  এই অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে।  ওইদিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর ভূমি অধিগ্রহণের অনাপত্তি ছাড়পত্রের আবেদন করেছিল চসিক।  পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমের জন্য পত্র দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।  ওই সময় জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করলেও ‘এলাইনমেন্ট’ জটিলতায় পড়ে।  কেননা ডিপিপিতে যেসব জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে অধিগ্রহণ অযোগ্য স্থাপনা (মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ইত্যাদি) ছিল।  ফলে গৃহায়ণ লিমিটেড নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে ‘এলাইনমেন্ট’ ঠিক করে চসিক।  এই কাজটি প্রকল্প অনুমোদনের আগে করার কথা থাকলেও প্রকল্প পরিচালকের গাফেলতি ও অদূরদর্শিতার কারনে এটি করতে হয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের পরে।  এই কারনেই ভূমি অধিগ্রহণের পুরোপুরি অর্থ ছাড় হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।  তবে ওই সময় প্রকল্পের বাজেটের বিপরীতে ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ছাড় দেয়া হয়।  যার পুরোটাই জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন।  পুরো অর্থ দিতে না পারায় ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।  ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি।  এর বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লক্ষ্য ৫৬ হাজার টাকা।  যা প্রকল্পটির প্রথম বাজেটের চারগুণ বেশি।  আর ভূমি অধিগ্রহণের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা আরও একবছর আগে জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেয় সিটি কর্পোরেশন।  কিন্তু তারপরও এগোয়নি ভূমি অধিগ্রহণ।  আলোর মুখ দেখেনি বহুল প্রত্যাশিত ও জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি।

ডিসি/এসআইকে/আরআর