পানির নিচেই যাচ্ছে চট্টগ্রাম, সমাধানে ব্যয় হয়ে গেছে ৩৫০০ কোটি টাকা

নগরে ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের সিডিএ আবাসিক এলাকা। বেলা ১২ টায় তোলা ছবি।

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রাম নগরীর পুরোনো সমস্যা জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টিতে কিংবা জোয়ারের পানি নগর ডুবে যাওয়া, হাঁটু কিংবা কোমর সমান পানিতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়া এ শহরের জন্য নতুন কিছু নয়।  বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এই সমস্যা সমাধানে।  কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।  সর্বশেষ ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড।
জলাবদ্ধতা নিরসনে নেয়া এসব প্রকল্পে গত তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে সংস্থাগুলো।  কিন্তু এর কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী।  মাত্র ৪৪ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে ফের দেখা মিলেছে সেই চিরচেনা জলাবদ্ধতার।  বরং অতীতে যেসব এলাকায় পানি জমত না, এবার সেই এলাকাগুলোও ডুবেছে পানিতে।  গত রবিবার সকালে মাত্র দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরীর বিভিন্ন নিচু এলাকা।  দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।  অনেকের বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে পানি।  সেসব স্থানে ঘটে অপ্রীতিকর নানান ঘটনা।  আহত হন অসংখ্য সাধারণ পথচারী যারা প্রয়োজনের তাগিদে নেমেছেন রাস্তায়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় নগরীর জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাকলিয়া, চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, উত্তর কাট্টলীর কিছু অংশ, দক্ষিণ কাট্টলীর বেশকিছু অংশ, নয়া বাজার, হালিশহর, আগ্রাবাদ সিডিএ, উত্তর পাহাড়তলী, সরাইপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা।  এতে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দিলোয়ার ইবনে মিজান বলেন, অফিসের কাজে শহরে এসেছিলাম।  জিইসির মোড় পর্যন্ত এসে জলাবদ্ধতার কারণে আর যেতে পারছি না।  এখন কাজ না সেরেই ফিরে যাচ্ছি।
আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইয়াসিন বাবুল বলেন, নিয়মিত অটোরিকশায় চড়ে অফিসে যাওয়া-আসা করি।  জলাবদ্ধতার কারণে অটোরিকশার দেখা নেই।  দুই-একটি থাকলেও তারা ভাড়া চাইছেন দ্বিগুণেরও বেশি, কেউ কেউ যেতেই চাইছেন না পানির কারণে।  এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে ঠাঁসাঠাসি বাসেও যাওয়ার সুযোগ নেই।  যদিও অনেকে যাচ্ছেন।  কিন্তু সেটি আমি নিরাপদ মনে করছি না।  দেখা যাক কি হয়।  নয়তো বাসায় ফিরে যাবো।
সম্প্রতি এ জলাবদ্ধতার জন্য খালের মধ্যে দেয়া বাঁধকে দায়ী করেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।  বাঁধের কারণে নগর ডুবে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটু ধৈর্য ধরতে হবে নগরবাসীকে।  তবে প্রকল্পের জন্য খালের মুখে দেয়া বাঁধ দ্রুত অপসারণ করতে হবে।  তা না হলে এই বর্ষাতেই গলাপানিতে ডুববে চট্টগ্রাম।
জলাবদ্ধতা দূর করতে তিন সংস্থার চার প্রকল্প জলাবদ্ধতা দূর করতে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের পাশাপাশি ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।  ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।  ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক।  ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।  পরের বছরের ২৮ এপ্রিল খালের আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।
এরইমধ্যে নগরীর ৩৫টি খাল থেকে তিন হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি ৫৪টি ব্রিজ-কালভার্টের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।  তবে শেষ হয়নি পাঁচটি খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ কাজ।  খালগুলোর পাশে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে ৫৮ কিলোমিটারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  পাহাড়ের বালি আটকাতে ৪২টি সিলট্র্যাপের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র ১৫ টির।  এছাড়া খালের দু’পাড়ে ৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কথা থাকলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র দেড় কিলোমিটার।  সব মিলিয়ে প্রকল্পে অগ্রগতি কেবল অর্ধেক।  কিন্তু ব্যয় হয়ে গেছে ১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
পাউবোর খরচ ৫০ কোটি
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়।  ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।  প্রকল্পটির আওতায় ২৩টি খালের মুখে বসানো হবে রেগুলেটর।  কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণ করা হবে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল।  যা বন্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।  এরইমধ্যে তিনটি রেগুলেটরের কাজ চলছে।  বন্যা প্রতিরোধে শুরু হওয়া কাজ রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে।  আর এরমধ্যেই ব্যয় হয়ে গেছে ৫০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক কর্নেল কবিরুল ইসলাম বলেন, আর্থিকসহ নানা সংকটে পুরোদমে কাজ করা যায়নি।  প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
বাড়ইপাড়া খাল খনন প্রকল্প
২০১৪ সালের ২৪ জুন ‘বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক।  ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)।  এরপর প্রায় সাত বছর পেরোলেও এখনো কাজই শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি।  এরইমধ্যে দুই দফায় বাড়ানো হয় মেয়াদ।  দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে।  সব মিলিয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো শূন্যের কৌটায়।  অথচ জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৯১১ কোটি টাকা।  এছাড়া পাঁচটি লটে ভাগ করে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এখনো অনুমোদন মেলেনি তিনটি লটের।  দুটি লটের অনুমোদন মিললেও এখনো ভূমি বুঝিয়ে দেয়নি জেলা প্রশাসন।
জানতে চাইলে চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা ব্যয় হবে জমি অধিগ্রহণে।  এরমধ্যে জমি অধিগ্রহণের ২০৮ কোটি ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ১০৬ কোটি টাকা চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয়ের কথা ছিল।  কিন্তু ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য চসিকের নেই।  ফলে জেলা প্রশাসনকে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা একসঙ্গে দিতে না পারায় ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াও থমকে আছে।  প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা সরকারি তহবিল থেকে দেয়ার জন্য এরমধ্যে প্রকল্প সংশোধন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
চাক্তাই-কালুরঘাট সড়ক নির্মাণ প্রকল্প
২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক।  ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।  অনুমোদন পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্পটির আওতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে আট দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সড়কসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে।  এরইমধ্যে সাতটি স্লুইসগেট নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ ও তিনটির ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে।  বাকি দুটির কাজ রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে।  এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে।  অথচ অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ আর এরইমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৬৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ বলেন, ১২টি স্লুইসগেটের মধ্যে পাঁচটির অবকাঠামো কাজ শেষ হয়েছে।  এখন পাম্প ও গেট বসানোর কাজ বাকি আছে।  সেগুলো ইউরোপ থেকে আমদানি করা হবে।  করোনা পরিস্থিতির কারণে আসতে দেরি হচ্ছে।  তাই বর্ষায় গেটগুলো চালু করা সম্ভব হবে না।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ