চট্টগ্রামে দিনে ১৪ সংসার ভাঙায় এগিয়ে নারীরা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
রোকসানা আকতার রুনা (ছদ্মনাম)। ১৫ বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সাইমন জাকারিয়াকে (ছদ্মনাম)। তাদের সংসারে দুটি সন্তান রয়েছে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি আরেকটি বিয়ে করেন জাকারিয়া। বিষয়টি শুরুতে গোপন থাকলেও পরে জানাজানি হয়। এরপরই শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। এভাবে চলতে থাকলে একপর্যায়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন রুনা ও জাকারিয়া। শেষমেশ বিচ্ছেদও হয় এ দম্পতির।
এরপর দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে ওঠেন রুনা। বর্তমানে সেখানেই থাকছেন। এ বিষয়ে কথা হয় রুনার সঙ্গে। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এ নারী।
রুনা বলেন, পরিবার রাজি না থাকা সত্ত্বেও জাকারিয়াকে বিয়ে করেছিলাম। ১৫ বছরের সংসার আমাদের। নিজেদের মধ্যে কখনো দুই কথা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ তিনি আরেকটি বিয়ে করে ফেলেন। বিষয়টি আমি জানতাম না। অনেকদিন পর কোনো এক মাধ্যমে জানতে পারি। এরপর এটি নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমাকে নানা ভাষায় গালাগাল করতেন জাকারিয়া। যা ১৫ বছরের সংসারে কখনো দেখিনি।
তিনি বলেন, ভেবে দেখলাম এভাবে আসলে হয় না। পরে একপর্যায়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেই। এখন দুই সন্তান নিয়ে কোনোমতে জীবন চালিয়ে যাচ্ছি।
শুধু রুনা আর জাকারিয়া নন, চট্টগ্রাম নগরে এমন বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তাদেরই আরেকজন হলেন বিলকিছ আরা (ছদ্মনাম)। নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বছর তিনেক আগে পারিবারিকভাবে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন না যেতেই বিলকিছ জানতে পারেন স্বামী মাদকাসক্ত। টেকেনি সেই সংসারও।
বিলকিছ বলেন, পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। ছেলের ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। কিন্তু বিয়ের পর দেখি তিনি মাদকাসক্ত। প্রতিরাতে দেরি করে বাসায় ফিরে আমাকে মারধর করতেন। বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে চেষ্টা করেছিলাম ভালো পথে আনার। পারিবারিকভাবেও চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। শেষে আলাদা হয়ে যাই।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি মেয়েই চায় স্বামীর সংসারে একটু সুখ পেতে। কিন্তু সেই সুখ সবার কপালে থাকে না। শুধু টাকা থাকলেই হয় না, চরিত্রও ভালো হতে হয়।
একই রকম গল্প নুরী-সাইখুল (ছদ্মনাম) দম্পত্তির মধ্যে। স্ত্রীর পর্দাহীন চলাফেরার অভিযোগসহ নানান অভিযোগ এনে বিচ্ছেদ ঘটে তাদের মধ্যে। ১ মেয়ের বাবা-মা এই দম্পত্তির সুখের সংসার ভেঙে যায় মুহুর্তেই। নুরীর বিরুদ্ধে সাইখুলের অভিযোগ- নুরী বিয়ের পরেও ছেলে বন্ধুদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন। স্বামী ঘরে আসার পরও দীর্ঘ সময় ধরে ছেলে বন্ধুর সাথে কথা বলা, বেপর্দা চলাফেরা, কথা না শোনার বিষয়গুলো অনেকবার নানানভাবে নিজে, পরিবার, তাদের পরিবারের সদস্যরাও বুঝিয়েছে। কিন্তু কমছিল না। আমার ৭ বছরের মেয়েটাকে অনেক সময় খাবার টেবিলে বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু নুরী খাবার তৈরি করতে গিয়েও কথাও মগ্ন থেকেছে পুরো সময়। বিষয়গুলো প্রায়ই ঘটে। তাই বাধ্য হয়ে পরিবর্তন না আসায় তালাক দিয়েছি।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে বিয়ে বিচ্ছেদ চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের সালিশি আদালতে আবেদন করেছেন ৩ হাজার ৫৭২ জন। সে হিসাবে ২৪ ঘণ্টা বা একদিনে গড়ে ১৪টি বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে এ আদালতে। এছাড়া আবেদনকারীদের বেশিরভাগই নারী।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সালিশি আদালতের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস বলেন, সংসার ভাঙার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। উচ্চ থেকে নিম্ন সব শ্রেণিতেই বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। তবে গত বছরের তুলনায় সেই হার এ বছর বেশি। তিনি বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়- মাদকাসক্তি, স্মার্টফোনে আসক্তি, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই বেশিরভাগ বিচ্ছেদ ঘটে। এর পাশাপাশি সহনশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবও লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া অর্থনৈতিক অস্থিরতাও একটি বড় কারণ। বরপক্ষের যৌতুক ও কনেপক্ষের দেনমোহরের চাপও এর জন্য দায়ী।
জাহানারা ফেরদৌস আরো বলেন, করোনাকালে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। করোনায় দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো একে অন্যের দোষ-ত্রুটি মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণেও বিয়ে ভাঙছে। তবে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। আবেদনের পর অনেক সময় দুই পক্ষকে বুঝিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। যদিও সেই সংখ্যা অনেক কম।
চসিকের সালিশি আদালতে জমা পড়া বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উচ্চ থেকে নিম্ন সব আবেদনের ভাষা প্রায় একই।
নারীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখানো হয়- যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামী পরনারীতে আসক্তি কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি ইত্যাদি।
অন্যদিকে পুরুষের পক্ষ থেকে- স্ত্রীর পরকীয়া, স্বামীর অবাধ্য হওয়া, যৌথ পরিবারে থাকতে অসম্মতি, সন্তান না হওয়া ইত্যাদি।
পরিংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালে চসিকের সালিশি আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করেন ৪ হাজার ৮৫৪ জন। ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৫৫০, ২০১৮ সালে করেন ৪ হাজার ৩৩১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৯২৮, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৯৬১, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৪৮৬ ও ২০১৪ সালে ৩ হাজার ২৬৮ জন বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি আবেদন ছিল নারীদের। অর্থাৎ বিয়ে বিচ্ছেদে নারীরাই এগিয়ে বলা চলে।
নিয়ম অনুযায়ী, বিয়ে বিচ্ছেদে ইচ্ছুক পুরুষ বা নারীকে প্রথমে তার সিদ্ধান্তের কথা লিখিতভাবে (তালাক নোটিশ) সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে জানাতে হয়। যাকে তালাক দিতে ইচ্ছুক তাকেও সেই নোটিশ পাঠাতে হয়। আবেদন পেয়ে মেয়র নোটিশটি সালিশি আদালতে পাঠিয়ে দেন। আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। আদালত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেন। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা করে আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

ডিসি/এসআইকে/আরসি