দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মিরসরাইয়ের ‘মহামায়া’

অপরূপ মহামায়া লেক

আজমল হোসেন, মিরসরাই >>>
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মিরসরাইয়ে পাহাড়ের পানি আটকে তৈরি হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক, ‘মহামায়া’। উপজেলার ঠাকুরদিঘী বাজার থেকে পৌনে এক কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত মহামায়া সেচ প্রকল্প। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহামায়ার পানি সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে মিরসরাইয়ে পানিশূন্য মৌসুমে ফসল উৎপাদন কাজে জাগিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। এ প্রকল্পের সুবাদে উপজেলার ১২শ হেক্টর অনাবাদি জমি সেচের আওতায় আসে। পাহাড়ের পানি আটকে পানি বন্টনের পাশাপাশি ক্রমশ মহামায়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পর্যটনস্পট হিসেবে।
বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ এটিকে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক হিসেবে ঘোষণা দেয়। সম্প্রতি এর পর্যটক সংখ্যা এতো ব্যাপক হারে বাড়ছে যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লেকের জলে ভাসমান বিভিন্ন ডিঙি নৌকা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ভেলা ও ছোট-বড় বোটগুলো পর্যটক নিয়ে চষে বেড়ায় সমস্ত লেকজুড়ে। সম্প্রতি লেক ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে কায়াকিং। পূর্ববর্তী বছরগুলোর চেয়ে চলতি পর্যটন মৌসুমে বেড়েছে পর্যটক সংখ্যা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তÍ থেকে প্রতিদিন ছুটে আসছেন শত শত পর্যটক। লেকের টলটলে স্বচ্ছ জলে দ্বীপের মত পাহাড়ের ঢিবি, পাহাড়ি গুহা, সব মিলিয়ে এ যেন এক অনিন্দ্য সুন্দর।
প্রাণের টানে ছুটে আসা পথ যেন ক্রমশই বন্ধুর হতে চাইবে মনের কোণে জাগা মৃদু উত্তেজনায়। দূর থেকে দেখা যায় প্রায় পাহাড়সম বাঁধ। উভয় পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাঁধের ধারে অপেক্ষমান সারি সারি ডিঙি নৌকো আর ইঞ্জিনচালিত বোট। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের লেক কেবল সুভা ছড়ায়। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে স্বচ্ছ পানিতে তাকাতেই দেখা যায় নীলাকাশ। পূর্ব-দিগন্তের সারি পাহাড়ের বুক চিরে যেতে যেতে একসময় হারিয়ে যেতেও মন চাইবে কল্পনায়। সঙ্গের সাথী পাশে নিয়ে গেলে তো কথাই নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে গেলেও কোনো বারণ নেই। কিছুদূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের কান্না। অঝোরে কাঁদছে। অথচ তার কান্না দেখে নিজের কাঁদতে ইচ্ছে হবে না। উপরন্তু কান্নার জলে গা ভাসাতে মন চাইবে। তারও পূর্বে যেখানে লেকের শেষ প্রান্ত, সেখানেও বইছে ঝর্ণাধারা। কি নীল, কি সবুজ, সব রঙের ছড়াছড়ি যেন ঢেলে দেওয়া হয়েছে মহামায়ার প্রকৃতিতে। এর সঙ্গে মিশতে গিয়ে মন এতটাই বদলে যাবে, যেন মন বারবার ঘুরে আসতে চাইবে ফেলে আসা স্মৃতিতে।
২০১০ সালে মহামায়া সেচ প্রকল্প বাস্তাবায়নের পর এই এলাকায় পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর পর সেখানে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। বর্তমানে পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের গোবানীয়া, জোরারগঞ্জ ও হিঙ্গুলী বিটের এ এলাকাটি। এ কারণে সরকার এখানকার পর্যটন সুবিধা কাজে লাগিয়ে নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের বৃহৎ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

মহামায়া লেকে নীল-সবুজের মহারণ।

চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আবু বকর সিদ্দিক দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রস্তাবিত এক প্রকল্পের আওতায় মহামায়াকে নতুন আদলে গড়ে তোলা হবে। দুই হাজার একর বনভূমি ঘিরে তৈরি এ পর্যটন এলাকায় সংরক্ষণ করা হবে উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৩০টির মত উন্নয়ন খাত। এসবের মধ্যে বিস্তারিত মহাপরিকল্পনাসহ পার্কের প্রাকৃতিক বিবরণ সংক্রান্ত ডিজিটাল জরিপ, দু®প্রাপ্য ও বিপদাপন্ন দেশীয় প্রজাতির দীর্ঘমেয়াদী ৩শ হেক্টর নতুন বনায়ন, দেশীয় প্রজাতির ৩শ হেক্টর ফলদ বৃক্ষের বনায়ন, ওষুধি বৃক্ষের ৫০ হেক্টর, গাড়ি পার্কিং এর জন্য ৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, পার্কিং এলাকার উন্নয়ন, আবাসিক ফাংশানাল ভবন নির্মাণ, নিরাপত্তার জন্যে ৭শ মিটার দৈর্ঘ্যরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে দুই দুইটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ, পাহাড়ে আরসিসি সিঁড়ি ও প্লাটফর্ম নির্মাণ, তিনতলাবিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ, একটি করে পিকনিক শপ ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, চারটি পিকনিক স্পট, কচ্ছপ প্রজনন ও জলজ পক্ষিশালা স্থাপন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পার্কের বিভিন্ন স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন স্থাপন, পর্যটকদের জন্য শৌচাগার এবং ওয়াশরুম নির্মাণ, পর্যটকদের জন্য পার্কের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হবে আরসিসি বেঞ্চ, পার্কের ভেতরে ২শ মিটার অভ্যন্তরীণ সড়ক ও পায়ে চলাচলের জন্য ২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ, গভীর নলকূপ ও পানি নিস্কাশনের জন্যে ড্রেন নির্মাণ ও ৩শ মিটার গাইডওয়াল নির্মাণ প্রকল্প।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলটি হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন হাবে- এমনটাই প্রত্যাশা পর্যটনসংশ্লিষ্টদের।

ডিসি/এসআইকে/আহো