সমবায়ের গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি : মিরসরাইজুড়ে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১২০০ জনের

গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচিতে বদলে যাচ্ছে মিরসরাই। ফাইলফটো

আজমল হোসেন, মিরসরাই প্রতিনিধি
‘সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন’ নামে একটি উন্নয়নমুখী যুগান্তকারী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে মিরসরাই উপজেলা সমবায় অফিস যা বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। এই কর্মসূচির প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হলো গ্রামের শিক্ষিত ও বেকার ছেলে-মেয়েদের ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এতে করে তারা স্বাবলম্বী হতে পারবে। প্রাথমিকভাবে উপজেলার ৬০টি গ্রাম নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে সমবায়ের অধীনে একটি করে সমিতি গঠন করা হবে এবং এ সমিতিগুলোর প্রতিটিতে থাকবে একজন করে গ্রামকর্মী। এভাবে প্রতিটি গ্রামে একজন করে ৬০ গ্রামে ৬০ জন গ্রামকর্মী সৃষ্টি হবে। যারা মাঠপর্যায়ে সমবায় সমিতি নিয়ে কাজ করবে এবং প্রশিক্ষণসহ সার্বিক কাজে সমবায় বিভাগকে সহযোগিতা করবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল থেকে উন্নয়নকর্মী সৃষ্টি হবে। শহরের আদলে গঠিত হবে গ্রাম। কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১২০০ লোকের। যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে সমবায়ের প্রধান ভিত্তি টেকসই উন্নয়ন। দৈনিক চট্টগ্রাম এর কাছে এমন তথ্য জানান উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা দীপক দাস।
সমবায়ের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ সকল শ্রেণি-পেশায় নিয়োজিত গ্রামবাসীদের সার্বিক গ্রাম বা নিজেদের সংঘবদ্ধ উন্নয়ন। একার পক্ষে একটি সমাজ উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু ১০ জন সমমনা ব্যক্তি যখন একত্রিত হয় এবং একটি টেকসই উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয় তখন তা সমাধান হয়ে যায় খুব সহজেই। সমন্বিত প্রচেষ্টা যেকোনো জটিল ও কঠিন কাজকে করে দেয় সহজ। একক প্রচেষ্টায় যা অসম্ভব তা সম্মিলিত উদ্যোগে করা যায় অনায়াসেই। সমন্বিত এ প্রচেষ্টার ভিত্তি হচ্ছে সমবায়। সমবায়ের সুফল বহুমাত্রিক। একতা, জাগরণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বিপনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বেকারত্ব নিরসনসহ সর্বোপরি দারিদ্র বিমোচনে সম্ভব। এবং সমবায়ের মাধ্যমে সম্ভব টেকসই উন্নয়ন।
মিরসরাইয়ে উৎপাদনমুখী সিআইজি সমবায় সংগঠনের সাফল্য এসেছে বহুমাত্রিক। উপজেলায় সমবায় অফিস কর্তৃক অনুমোদিত ও নিবন্ধিত মোট প্রাথমিক সমবায় সংগঠন ২৬১টি এবং বিআরডিবি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি রয়েছে ২ টি। তার মধ্যে সিআইজি উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি ১৮০টি। এ উৎপাদনমুখী সিআইজি সমবায় সমিতিগুলো অর্জন করেছে বহুমাত্রিক সাফল্য। পেশাভিত্তিক সমবায়ীরা একমত হয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন এসব সমবায় সমিতি। সমবায়ের মাধ্যমে বেড়েছে সামষ্ঠিক উন্নয়ন। যা গ্রামীণ দারিদ্র লাঘবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।


মিরসরাই সমবায় অফিসার দীপক দাস দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, মিরসরাইয়ে সমবায় কার্যক্রম বহু আগে থেকেই চলমান। নিবন্ধিত যে সমবায় সমিতিগুলো রয়েছে তারা নিজেদের জামানো টাকায় কোনো না কোনো কাজ করে স্বাবলম্বী। এক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলো সরকারি কোনো সহায়তা পায় না। সরকারি কোনো অনুদান না পেয়েও মিরসরাইয়ে উৎপাদনমুখী ও মুনাফাভোগী বেশকিছু সমবায় সমিতি সফলতা লাভ করেছে।


উৎপাদনমুখী সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত পশু সমবায়ে রয়েছে ৩ ধরনের ক্ষেত্র। হাঁস-মুরগি পালন ও ডিম উৎপাদন, গরু মোটাতাজাকরণ ও গাভী পালন। এ ক্ষেত্রগুলোতে সফল ৩ টি সমবায় সমিতি হলো গোভনীয়া হাঁস, মুরগি পালন সিআইজি সমবায় সমিতি, গোভনীয়া গরু মোটাতাজাকরণ সিআইজি সমবায় সমিতি ও গোভনীয়া গাভি পালন সিআইজি সমবায় সমিতি। তিনটি সমিতিতে উন্নয়নকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন রোকেয়া বেগম। উৎপাদনমুখী এ সমবায়ের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রোকেয়া বেগম জানান, আমরা নামে মাত্র সমবায়ে নিবন্ধিত। সমবায় থেকে আমরা কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা পাই না। পাই না কোনো অনুদান। আমরা নিবন্ধিত যে কয়টি সমিতি আছি তারা ব্যক্তি উদ্যোগে গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ ও হাঁস-মুরগি পালনে বিনিয়োগ করে সফল। কিন্তু আমাদের সফলতা ব্যর্থতায় হাত নেই সমবায় অফিসের। সমবায় অফিস থেকে আমরা কোনোরূপ অনুদান পাই না। মাঝেমধ্যে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বর্তমানে তাও বন্ধ আছে।
মাছ চাষ ও আমিষের চাহিদা পূরণ ক্যাটাগরিতে অনেকগুলো মৎস সমবায় রয়েছে উপজেলা সমবায় অফিস পরিচালিত। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মুহুরী প্রকল্প মৎস চাষ সিআইজি সমবায় সমিতি ও বাঁশখালী মৎস চাষ সিআইজি সমবায় সমিতি।


মুহুরী প্রকল্প মৎস চাষ সিআইজি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার এগ্রোর স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সমবায়ের আওতায় আসার মাধ্যমে আমাদের পূর্বের প্রতিবন্ধকতাগুলো কেটেছে। আগে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে মাছ চাষ করতাম। বর্তমানে সমবায় করার ফলে আমরা প্রশাসনের সহায়তা পাচ্ছি। ঐক্যবদ্ধ থাকার কারণে যেকোনো ধরণের সমস্যা আমরা অতিদ্রুত ও সহজে সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছি। নিজস্ব অর্থায়নে মাছ চাষ করে আমরা মোটামুটি সফল।
কৃষি সমবায়ের ক্যাটাগরিতে যে কয়টি উৎপাদনমুখি সমবায় সমিতি রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চরশরৎ পুরুষ সিআইজি সমবায় সমিতি লিমিটেড, মুরাদপুর পুরুষ সিআইজি সমবায় সমিতি লিমিটেড ও আমানটোলা পুরুষ সিআইজি সমবায় সমিতি লিমিটেড। কথা হয় চরশরৎ পুরুষ সিআইজি সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সভাপতি রাধেশ্যাম দাশের সাথে। তিনি বলেন, আমারা চরাঞ্চলের অসহায় দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে এ সমবায় সমিতিটি গঠন করেছি। তার থেকে আমরা বহুমুখী সুফল পাচ্ছি। যদিও আমাদের এখনো ক্ষুদ্র পরিসর, আমরা সমবায় থেকে কৃষকদের উন্নয়নে পাওয়ারটিলার কিনেছি। তা দিয়ে আমাদের কৃষকদের জমি চাষ করা হয় এবং সমবায়ের বাইরের কৃষকদের জমি চাষের মাধ্যমে আমরা কিছু টাকা আয় করতে সক্ষম হচ্ছি। সমবায়ের বাইরেরও আমরা অসহায় দরিদ্র কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহয়তা করার চেষ্টা করি। এছাড়াও আমাদের সমবায় থেকে সমাজসেবার লক্ষ্যে আমরা কোন দারিদ্র মেয়ের বিয়েতে সাধ্যমত অনুদান দিতে চেষ্টা করি। মোট কথা এ সমবায় করে আমরা নানাভাবে উপকৃত হচ্ছি।
উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতির বাইরেও মুনাফাভোগি কিছু সমবায় সমিতি রয়েছে। যারা মূলত সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখে, সঞ্চয় গ্রহন করে ও তার দ্বারা মূলধন গঠন করে ঋণদান কর্মসূচি পরিচালনা করে। মিরসরাই সমবায় অফিস নিবন্ধিত সফল ঋণদানমূলক সমিতির মধ্যে আবুতোরাবের কনসাল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি ও বারইয়ারহাটের রয়েল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি উল্লেখযোগ্য। কনসাল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি ও বারইয়ারহাটের রয়েল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি মূলত সঞ্চয় গ্রহণ ও ঋণদান কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বর্তমানে এ দু’টি সমিতি বৃহদাকার ধরণ করেছে। এছাড়াও ইভা বহুমূখী সমবায় সমিতি নামে আরো একটা মুনাফাভোগি সমবায় সংগঠন রয়েছে। তবে এ সংগঠনটি ঋণদান কর্মসূচির সাথে জড়িত নয়। এ সমিতির মাধ্যমে নিজের পুঁজি দ্বারা রিয়েলএস্টেটের ব্যবসা পরিচালিত হয়।

ইভা বহুমূখী সমবায় সমিতির সভাপতি ডা. গিয়াস উদ্দিনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, সমবায়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে তারা সফল। তবে কাঙ্খিত মাত্রার সফলতায় এ সমিতি এখনো পৌঁছাতে পারেনি। তার একমাত্র প্রাতিবন্ধকতা হলো, তাদের সমিতির নামে রেজিস্ট্রিকৃত জমি কিনতে হলে ক্রেতাদের প্রকৃত রেজিস্ট্রি খরচের তুলনায় ৮% বেশি রেজিস্ট্রি খরচ সরকারকে দিতে হয়। যা জমি ক্রেতাদের জন্য বড় অংকের একটা চাপ হয়ে যায়। সে কারনে সাধারণ মানুষ সমিতি থেকে জমি ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করে। এতে করে তাদের ব্যবসায়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তার তার একসময় ব্যবসা গুঁটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। সরকারে এই ৮% বাড়তি ভ্যাটনীতি বন্ধ করার দাবি জানান এ সমিতির সভাপতিসহ অন্যান্যরা।
বিআরবিডির অধীনে রয়েছে সমবায়ের আরো দু’টি কেন্দ্রীয় সমিতি। প্রাথমিক মুনাফাভোগি মাল্টিপারপাস সমিতিগুলো ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থে। তারা এক্ষেত্রে সরকারি কোনো সহায়তা পায় না। কিন্তু বিআরবিডি সমবায়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহায়তা পায় ও সরকারি তত্বাবধানে সরকারি টাকায় ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে।
মিরসরাইতে সমবায়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, আমি মিরসরাইয়ের সমবায় নিয়ে ততটা আশাবাদি না। বরং কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মিরসরাইয়ে এতোগুলো সমবায় সমিতি থাকলেও ততটা সফল বা চোখে পড়ার মতো কোনো কার্যক্রম আমার নজরে পড়েনি। তার চাইতে সমাজসেবা কার্যালয়ের অধীনে যেসমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনসমূহ রয়েছে সেগুলো নানামুখী সফলতা লাভ করছে। আশা করছি সমবায় সংগঠনগুলোর দূরাবস্থা কেটে যাবে এবং ভবিষ্যতে ভালো কিছুর প্রত্যাশা রাখছি।

ডিসি/এসআইকে/এসএএইচ