চরাঞ্চলে হুমকির মুখে গবাদি পশুর চারণভূমি, দূর্দশায় মিরসরাইয়ের পশুপালনকারী পরিবারগুলো

গৃহপালিত পশুরচারণ ভূমি পরিণত হচ্ছে ইকোনোমিক জোনে।
গৃহপালিত এসব পশুর এই চারণভূমি যেন ইতিহাস হতে চলেছে। ছবি সংগৃহিত

আজমল হোসেন, মিরসরাই প্রতিনিধি >>>
উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় চরাঞ্চল ছিলো গবাদি পশুর ঊর্বর চারণভূমি। উপযুক্ত চারণভূমি থাকার সুবাদে মিরসরাইয়ের অন্যতম অর্থকরী সম্পদের মধ্যে মহিষ ছিলো অন্যতম। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় কিংবা শীত উপেক্ষা করে মহিষ দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায় ও ঘাস খায়। অন্যদিকে পশুপালনকারীরা গরু ছেড়ে দিতেন নিশ্চিন্তে। সারাদিন চারণভূমির ঘাস খেয়ে গরু-মহিষের দল ফিরে আসতো প্রিয় পালনকর্তার ঝুঁপড়ি ঘরে। কিন্তু মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে চরাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণের কারণে চরমভাবে হুমকিরমুখে পড়েছে গবাদিপশুর চারণভূমি। এতে ভয়াণক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্থানীয় দরিদ্র গরু-মহিষ পালনকারীরা। ইছাখালী ও ওচমানপুরের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর একমাত্র পেশা গরু-মহিষ পালন। চরাঞ্চলের পতিত জমিতে অবাধ বিচরণ ছিলো গবাদিপশুর। যেদিক দু’চোখ যেতো, সবুজ আর সবুজ। প্রাকৃতিক ঘাস খাইয়ে গরু-মহিষ মোটাতাজা করে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে চলে একেকজন রাখালের পরিবার। কিন্তু বর্তমানে উন্নয়নের ছৌঁয়ার হারিয়ে গেছে সেসব সবুজ চারণভূমি। সবুজের বদলে এখন চোখে পড়ে ধু ধু বালু। এ যেন কৃত্রিম মরুভূমি।
এসব চরাঞ্চলে ইকোনোমিক জোনের খেতাব লাগার পর থেকেই গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল। মিরসরাইয়ে যখন থেকে লেগেছে বাণিজ্যের ছোঁয়া তখন থেকেই হারাতে বসেছে গবাদি পশুর চারণভূমি, অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন অধিকাংশ পশুপালনকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠী। গরু-মহিষ কিংবা ছাগল পালনের মতো লাভজনক পেশা হারিয়ে তারা দিন-মজুরের কাজ করছেন। ফলে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন এসব পরিবার; লেগে থাকছে অভাব-অনটন।
মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলের মহিষের দুধ থেকে উৎপাদিত দইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা সমগ্র উপজেলাজুড়ে। মহিষের দুধ ও দই বিক্রি করে সংসার চালায় চরাঞ্চলের মহিষ পালনকারীরা। মিরসরাইয়ের ইছাখালীর চর ও চরশরৎ অঞ্চলের প্রধান পেশা মহিষপালন। ভোরে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শত শত মহিষের পাল নিয়ে বিস্তৃত চরের দূর সীমানায় ছুটে যান মহিষ পালকেরা। স্থানীয় গৃহস্থরা প্রায় অধিকাংশ পরিবার পালন করে একাধিক মহিষ। এসব মহিষগুলো সারাদিন চড়ে বেড়ায় ইছাখালী ও চরশরৎ এলাকার উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বাগানগুলোতে। খাবার খেতে খেতে দল বেঁধে ডুব দেয় পানিতে। আবাদকৃত জমি থেকে যখন ফসল ঘরে উঠানো হয় তখন মনের সুখে দাবিয়ে বেড়ায় কালো কালো মহিষের পাল। চরাভূমিতে জন্মানো প্রাকৃতিক ঘাস, জলাভূমির কচুরিপানা ও বিভিন্ন জাতের লতাপাতা মহিষের প্রধান খাদ্য। খাবার খেয়ে মহিষগুলো পালে পালে গা ডোবায় ডোবা কিংবা খালে। কিছু কিছু পাল দলবেঁধে চলে যায় উপকূলীয় জলাভূমিতে। সেখানে পানিতে গলা সমান ডুবে থেকে জাবর কেটে দিনশেষে খোয়াড়ে ফিরে।

পশুর পাল নিয়ে ছুটে চলা রাখানের এমন ছবি দূর্লভ হতে চলেছে। ছবি সংগৃহিত

কিন্তু চরাঞ্চলে সম্প্রতি চোখে পড়ে না বড় বড় মহিষের পাল। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ছোট ছোট দু-একটা মহিষের পাল খাবারের খোঁজে ধু ধু বালুতে চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেখানে নেই কোনো সবুজ ঘাস। নেই গা ভিজিয়ে ডুবে থাকার মতো পানি। এ যেন ধু ধু মরুভূমি। খাবারের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে হাপাচ্ছে মহিষের দলগুলো। এতোদিন যেসব পতিত ভূমি ছিলো মহিষদের স্বর্গ। এখান সেখানে ধু ধু বালুচর। যে চরাঞ্চল ছিলো সবুজ ঘাসে ভরপুর সেখানে গড়ে উঠছে ভারী শিল্প। যার ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে মহিষপালকদের। এসময় কথা হয় একজন মহিষপালকের সাথে। তার নাম সিরাজুল ইসলাম। তিনি মহিষ পালন করেই নির্বাহ করেন তার ছয় সদস্যের পরিবার।
সিরাজুল ইসলাম জানান, একসময় সারাবছরই আমরা ৫০-৭০টা পর্যন্ত মহিষ একসাথে পালন করতাম। কিন্তু এখন এখানে শিল্পাঞ্চলে কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে যাওয়ায় আমরা আর ততবেশি মহিষ পালন করতে পারছি না। এখন আমি সর্বসাকূল্যে ২০ থেকে ২৫টা মহিষ পালন করি। ঘাসের অভাবে এ অল্পসংখ্যক মহিষ পালন করতে আমিসহ আমার মতো যত মহিষ পালক আছে প্রত্যেককেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ফসলী জমিতে যখন ফসল বপন করা হয় তখন দুর্দশা বাড়ে চরমে। মহিষগুলো চরার জন্য কোনো জায়গাই থাকে না তখন। এসময় ঘাস খাওয়াতে না পেরে অনেকে লোকসানের মুখে কম মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এখন অঞ্চলের অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে মহিষপালন। এতে হুমকির মুখে মহিষের সুস্বাদু দুধ ও দধি উৎপাদন।
মহিষ মূল্যবান গৃহপালিত গৃহসম্পদ। মহিষপালন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখে। মহিষের শিং হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপজাত যেমন বোতাম, চিরুনী, চাবুক ও চুরির হাতল তৈরি হয়। গ্রামাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে মহিষকে জমি চাষ দেয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মহিষের দুধ খুবই সুস্বাদু ও উপকারী। মহিষের দুধ থেকে তৈরি হয় দই। এই দই বাজারে বেশ সমাদৃত ও চড়াদামে বিক্রি করা যায়। মহিষের গোবর সাধারণত কৃষকরা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এবং অনেকে এটিকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়াও মানুষের প্রয়োজনীয় প্রাণীজ আমিষের একটি বড় অংশ পূরণ করে মহিষের মাংস।

দ্রুততার সাথে গড়ে উঠছে মিরসরাই ইকোনোমিক হোন। রাষ্ট্র লাভবান হলেও কপাল পড়েছে অনেক হতদরিদ্রের।

কিন্তু চারণভূমির জন্য এসকল সুবিদা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে মিরসরাই উপজেলা। এভাবে দিনদিন চারণভূমি কমতে থাকলে একসময় মিরসরাইয়ে গণহারে কমতে থাকবে লাভজনক মহিষসহ অন্যান্য পশুপালন।
এ বিষয়ে উপজেল নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ফলে তার থেকে যে দেশীয় আয় আসবে তা পশু পালন থেকে কয়েকশত গুণ বেশী হবে। তবে এ কথাও সত্য যে দেশীয় আয় বৃদ্ধি পেলেও হ্রাস পাবে স্থানীয় আয়। যে সকল মহিষ পালনকারীরা পালে পালে মহিষ পালন করতেন তাদের পেশা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের নতুন পেশায় পুনর্বাসন করা অতীব জরুরি। ক্ষতিগ্রস্ত পেশাজীবীদের পুনর্বাসনে সরকারের প্রতি আমার আহ্বান রইলো।

ডিসি/এসআইকে/এএইচ