সুমি হত্যাকাণ্ড : মামলার এজাহার সম্পর্কে জানেন না বাদি, তড়িঘড়ি মামলা দায়েরের অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

আজমল হোসেন, মিরসরাই প্রতিনিধি >>>
মিরসরাইয়ের আলোচিত নাহিদা আক্তার সুমি হত্যাকাণ্ডে মূল ঘটনাকে আড়াল করে পুলিশের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি করে মামলা দায়েরের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার ১০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় হতাশ সুমির পরিবার। মেয়ে হারানোর শোকে মা পারভীন আক্তার পপি পাগলপ্রায়, মেয়ের শোকে প্রবাস থেকে ছুটে এসেছেন বাবা নুরুল আফসার। সুমির লাশ দাফনের পর পরিবার জানতে পারে এঘটনায় জোরারগঞ্জ থানায় পুলিশ একটি মামলা দায়ের করেছে। যেখানে ঘটনার সাথে মামলার বিবরণের কোনো মিল নেই। প্রকৃত ঘটনাকে ভীন্নখাতে প্রবাহিত করে জড়িত অন্য আসামিদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ছত্তরুয়া গ্রামের সুনুু মিয়া সওদাগর বাড়ির প্রবাসী নুরুল আফসারের কন্যা নাহিদা আক্তার সুমিকে হত্যা করে স্বামী মীর হোসেন প্রকাশ ফারুকসহ তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় জোরারগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত মামলায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৭ জনের বিরুদ্ধে সুমির পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হলেও থানা পুলিশ তাদের মনগড়া এজাহার লিখে তাতে শুধুমাত্র স্বামী মীর হোসেন ফারুককে আসামি করে। থানা পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বাকি ৬ জনকে বাদ দিয়ে সুমির ময়না তদন্তের কথা বলে মামলায় সুমির মা পারভীন আক্তার পপিকে বাদি করে স্বাক্ষর নিয়ে নেন। এই ঘটনায় পুলিশের প্রতি ক্ষুব্ধ সুমির পরিবার। সুমির পরিবারের দাবি- এজাহারে হত্যাকা-ের সাথে জড়িত তার শ্বশুর আক্তার মিয়া, জেঠা শ্বশুর সামছুদ্দিন মেম্বার, শাশুড়ি নুর খাতুন, গাড়িচালক মুক্তার হোসেন, বাসার মালিক নিজাম উদ্দিন ও তার স্ত্রী কাজল জড়িত থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র স্বামী মীর হোসেন ফারুককে আসামি করে এবং সুমির বিরুদ্ধে গাড়িচালক মুক্তার হোসেনের সাথে পরকিয়ার অভিযোগ এনে পুলিশ একটি এজাহার লিখে তাতে পারভীন আক্তারের স্বাক্ষর নিয়ে মামলা দায়ের করে। এতে দীর্ঘদিন ধরে স্বামী মীর হোসেন ফারুকের হাতে সুমি নির্যাতনের ঘটনাকে আড়াল করে হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টা করা হয়।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) মিরসরাই প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদা আক্তার সুমির মা পারভীন আক্তার এসব অভিযোগ করে বলেন, ২০১৩ সালের ২০ মে হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের চিনকীরহাট এলাকার আক্তার মিয়ার ছেলে মীর হোসেন প্রকাশ ফারুক কোম্পানীর সাথে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে আমার মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে ৫ পদের ফার্নিচার দেই। বিয়ের পর কিছু দিন তাদের সংসার সুখে কাটলেও বিগত চার বছর ধরে আরো যৌতুকের দাবিতে স্বামী মীর হোসেন ফারুক ও তার বাবা-মা আমার মেয়েকে শারিরীক অত্যাচার-নির্যাতন করতো। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন সময় তার স্বামীকে আমি প্রায় ৬ লাখ টাকা দিয়েছি। টাকা দেওয়ার পর কিছুদিন ভালো থাকলেও পরে আবার তারা নির্যাতন করতো। নির্যাতনের জন্য একাধিকবার গ্রাম্য সালিশও হয়। ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল জোরারগঞ্জ থানায় আমার মেয়ে বাদি হয়ে স্বামী মীর হোসেন ফারুক, শ্বশুর মো. আক্তার মিয়া, শাশুড়ি নুর খাতুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। এর প্রেক্ষিতে থানায় বৈঠক হয়। বৈঠকে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ভবিষ্যতে আর নির্যাতন করবেন না মর্মে পুলিশ বিবাদিদের থেকে মুচলেকা নিয়ে সুখের সংসার করবে মর্মে আমার মেয়েকে নিয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই ফারুকে নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। বরং দিন দিন তার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি পুনরায় ১ লাখ টাকা আনার জন্য আমার মেয়েকে মারধর করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয় তারা। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪ টায় সুমিকে আর মারধর করবে না এবং টাকা দাবি করবে না বলে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। পরেরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১ টার সময় আমার মেয়ের স্বামী মীর হোসেন ফারুক আমাকে ফোন দিয়ে বলে তোমার মেয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে তার লাশ নিয়ে যাও। এটি শোনার পর আমি দ্রুত সময়ে তাদের ভাড়া বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি সুমিকে মেরে বাসার সামনে ফারুকের প্রাইভেটকারের পেছনের সীটে তার লাশকে সোজা করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে গ্রামবাসীর সহায়তায় তার লাশ আমরা বাড়িতে নিয়ে যাই। খবর পেয়ে দুপুর ২ টায় জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ ময়নাতদনেন্তর জন্য লাশ নিয়ে যায়। একই দিন রাত ৮ টার সময় লাশের ময়নাতদন্ত ও জিডি করার কথা বলে ওসি (তদন্ত) মো. মাকসুদ আলম আমার থেকে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেন। মেয়ের শোকে ওই সময় আমার কোনো স্বজ্ঞান ছিলো না। পরবর্তীতে পত্রিকায় জানতে পারি আমার মেয়েকে খুনের ঘটনায় আমাকে বাদি করে জোরারগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সন্তানহারা সুমির মা পারভীন আক্তার অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রশাসনের কাছে মেয়ে হত্যার উপযুক্ত বিচার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা উল্লেখ করে পুনরায় মামলা নিয়ে আসামিদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। যেনো যৌতুকের জন্য নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাদিয়া আক্তার সুমির বাবা মো. নুরুল আফসার, ফুফা মো. মুসা মিয়া, খালা আছমা পারভীন আক্তার, খালু আবুল হাশেম মেম্বার।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জোরারগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রায়হান উদ্দিন বলেন, মামলার এজাহারের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে শুধু মামলাটি তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ফেলে কিভাবে মৃত্যু হয়েছে তা জানা যাবে।
জোরারগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাকসুদ আলম বলেন, মামলার বাদিকে সহায়তা করার জন্য থানায় এজাহার লেখা হয়েছিলো। তাতে বাদির বক্তব্যের বাইরে কোনো কিছু লেখা হয় নাই। তাছাড়া এজাহারটি অফিসার ইনচার্জ পর্যালোচনা করে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
জোরারগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, বাদির দেওয়া এজাহারের ভিত্তিতে মামলা নেওয়া হয়েছে। এজাহারে পুলিশের নিজস্ব বক্তব্য সংযোজনের কোনো সুযোগ নেই। পুলিশের তদন্ত শেষে ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে।

ডিসি/এসআইকে/এসএএইচ