২০০ বছর টিকে আছে চট্টগ্রামের ‘বেলা বিস্কুট’

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক যত খাবার রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো ‘বেলা বিস্কুট’।  সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের সঙ্গে বেলা বিস্কুট না হলে যেন চলেই না চাটগাঁবাসীর।  আবার বিকেলের আড্ডায়ও সঙ্গী বেলা বিস্কুট।  চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও উপমহাদেশের প্রথম এ বিস্কুটের খ্যাতি এখন দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বিশ্বেও।
কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল তার স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছিলেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তার কথা।  আত্মজীবনী ‘রেখাচিত্র’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, চট্টগ্রামের চন্দনপুরা এলাকায় এক বিস্কুটওয়ালা ছিলেন, যার নাম ছিল বেলায়েত আলী।  তার নাম অনুসারেই বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়।
‘রেখাচিত্র’ গ্রন্থটিতে তিনি একটি লাইন লিখেছিলেন, যা ছিল- ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে।  কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে’।
চাটগাঁর ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট রফতানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।  এছাড়া অনেক প্রবাসী দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান এ বিস্কুট।
ব্রিটিশ আমলেও তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার মানুষের প্রিয় খাবার ছিল বেলা বিস্কুট।  গরম গরম চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে সকাল-বিকেল নাশতা সেরে নিতেন তখনকার পৌরসভার মানুষেরা।  পরে ধীরে ধীরে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেগঞ্জে।
বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক আহমদ মমতাজের মতে, মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ নানা বেকারি পণ্য।  তাদের এ খাদ্যাভ্যাসের ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে।
শুরুর দিকে বেকারিতে রুটি তৈরি হলেও পরবর্তীতে তৈরি হতো পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট।  তখন থেকেই বেকারি পণ্যে অভ্যস্ত হতে থাকে চট্টগ্রামের মানুষ।
চট্টগ্রামের চন্দনপুরা কলেজ রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের দোকান ‘গণি বেকারি’।  গবেষকরা ধারণা করেন, আজ থেকে দুইশ’ বছর আগে উপমহাদেশে এ বেকারিতেই প্রথম তৈরি হয়েছিল বেলা বিস্কুট।  সেই থেকে এ বিস্কুটের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গণি বেকারির নাম।
গণি বেকারিতে সর্বপ্রথম কখন বেলা বিস্কুট তৈরি হয় তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে মোগল আমলের শেষ ও ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে ভারতের বর্ধমান থেকে আসা ব্যক্তিরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারিশিল্পের সূচনা করেন বলে জানা গেছে।
কারো কারো মতে, পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম এ বিস্কুটের প্রচলন ঘটান গণি বেকারির মালিক অব্দুল গণি সওদাগর।  মূলত তার নাম অনুসারেই বেকারিটির নামকরণ হয়।  আর এ বেকারির খ্যাতির কারণে জায়গাটির নাম এখন গণি বেকারির মোড়।
বিভিন্ন গবেষকদের লেখায় জানা গেছে, আবদুল গণি সওদাগরের পূর্বপুরুষ ছিলেন লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ।  তাদের হাত ধরেই এ অঞ্চলে বেকারি পণ্যের সূচনা হয়।
জানা যায়, পূর্বপুরুষের হাত ধরে ১৮৭৮ সালে বেকারিশিল্পে যুক্ত হয়েছিলেন আবদুল গণি সওদাগর।  ১৯৭৩ সালে তিনি মারা গেলে এ বেকারির হাল ধরেন তার ভাইয়ের ছেলে দানু মিঞা সওদাগর।  ১৯৮৭ সালে তিনিও মারা গেলে হাল ধরেন তার ছেলে জামাল উদ্দিন।  জামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর বর্তমানে রয়েছেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম।
গণি বেকারিতে গিয়ে পাওয়া গেল আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশামকে।  তিনি জানান, একতলা এ বেকারি ভবনটি তৈরি হয় ১৯১০ সালে।  এরপর থেকে বারবার সংস্কার করা হলেও টিকিয়ে রাখা হয়েছে তিনস্তর বিশিষ্ট ছাদের মূল অবকাঠামো।
বংশপরম্পরায় ধরে রাখা এ ব্যবসার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম বলেন, বেলা বিস্কুট আমাদের ঐতিহ্য।  সঙ্গে অন্যান্য আরো পণ্য রাখা হলেও মূলত বেলা বিস্কুটকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা ব্যবসা করছি।  সেই পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো মাটির তন্দুর রেখে দিয়েছি।  আগের রীতিতেই এখনো বেলা বিস্কুট তৈরি হচ্ছে।  দামও রেখেছি হাতের নাগালে।  ৪০ পিস বেলা বিস্কুটের দাম রাখা হয় ৯০ টাকা।
তিনি বলেন, সব শ্রেণি পেশার মানুষের পছন্দ বেলা বিস্কুট।  দূর দূরান্ত থেকে অনেকে আসেন শুধুমাত্র বেলা বিস্কুট কিনতে।  অনেকে আবার বিদেশেও নিয়ে যান।  বলতে গেলে শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশ ছাড়িয়ে এখন বাইরেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেলা বিস্কুট।  আমরাও আমাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।
দেখা গেছে, অন্তত ৩০ ধরনের পণ্য এ বেকারিতে তৈরি হলেও বেশিরভাগ ক্রেতা আসেন বেলা বিস্কুট কিনতে।  শো-রুমের সঙ্গেই বিস্কুট তৈরির কারখানা।  কারখানায় রয়েছে দুটি মাটির তৈরি তন্দুর।  তন্দুরে বানালেই ঠিক থাকে এ বিস্কুটের আসল স্বাদ ও গুণগত মান।  দুটি তন্দুরে দৈনিক ছয় থেকে আট হাজার পিস বেলা বিস্কুট তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন কারিগররা।
প্রথমে ময়দা, ডালডা, গুঁড়ো দুধ, চিনি, লবণ ও তেল মিশিয়ে তৈরি করা হয় খামি।  সঙ্গে দেয়া হয় বিশেষ ধরনের মাওয়া।  এরপর মাটির তন্দুরে একদিন রাখার পর প্রথম দফায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা সেঁকা হয়।  দ্বিতীয় দফা সেঁকা শেষে তৈরি হয় বেলা বিস্কুট।  এটি গোলাকার, আকারে বড় এবং সাধারণ বিস্কুটের চেয়ে তুলনামূলক শক্ত।
শুরু গণি বেকারির হাত ধরে হলেও বর্তমানে প্রায় সব বেকারিতেই তৈরি হয় বেলা বিস্কুট।  বংশপরম্পরায় এখনকার ক্রেতাদের মাঝেও রয়ে গেছে এ বিস্কুটের চাহিদা।  দীর্ঘ দুইশ’ বছরেও ভাটা পড়েনি এটির জনপ্রিয়তায়।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর