করোনা মহামারি থেকে রক্ষায় দূর্গম বাসিন্দাদের পাশে তথ্য অফিস-ভোরের আলো-ইউনিসেফ

রোকসানা আক্তার রুনা, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
মাস্ক পরি না। টিকা নিই না, নিকা নিলে মরি যাইবে- ত্রিপুরা ভাষা থেকে একটু বাংলা বলার চেষ্টার ছলে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১ নম্বর করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগরস্থ নলখাঁ ত্রিপুরা পাড়ার রুশ্মি ত্রিপুরা।  বারইয়ারহাট-খাগড়াছড়ি সড়কের নয়টিলা মাজারের সামনে দিয়ে নেমে যাওয়া প্রায় চলাচল অনুপোযোগী পথ বেয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের এই ১২০ পরিবার নিয়ে গঠিত অজপাড়া গাঁয়ের মানুষগুলোর নব্বই শতাংশই জানেন না করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার কথা।  করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নেয়ার কথা শুনেই তারা জানান টিকা নিলে মানুষ মরে যাবে।  মাস্ক পরাতো দূরের কথা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা তিনফুট দূরত্ব রেখে চলাফেরা করার ন্যূনতম মানসিকতা নেই তাদের।
শুধু এই ত্রিপুরাপাড়ার মানুষই নন, গত ২৯ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত একই ইউনিয়নের ৮০ পরিবারের সাইবেনীখিল ত্রিপুরাপাড়া, সীতাকুণ্ড উপজেলার দুই শতাধিক পরিবারের সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়া, হাটহাজারীর ৬৫ পরিবারের মনাই এবং ৫০ পরিবারের সোনাই ত্রিপুরা পাড়া, মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়াস্থ গহীন অরণ্যের প্রায় ২৫০ পরিবারের জুম্মু ত্রিপুরাপাড়া, ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের বড়বিলের যথাক্রমে ২০০ ও ৬০ পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা ত্রিপুরাপাড়া, একই উপজেলার খিরাম ইউনিয়নের বড়ইতলীর ৯৫ পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা চাকমা পাড়ার বাসিন্দারা করোনা ভাইরাসের মহামারি সম্পর্কে ছিলেন ধারণাহীন জাতি।  খুঁজে খুঁজে এই মানুষগুলোর কাছে যাচ্ছে চট্টগ্রামের একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবী।  শুধু এসব দূর্গম এলাকার ত্রিপুরাপাড়া-ই নয়, হাটহাজারী উপজেলার গুচ্ছগ্রাম (আদর্শপাড়া), সন্দ্বীপপাড়া, ফটিকছড়ি উপজেলার খিরাম ইউনিয়নের মগকাটা গ্রাম, মিরসরাই উপজেলার নিজতালুকের ভূঁইয়া পাড়ার ঘরে ঘরে গিয়ে এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের দলটি পৌঁছে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার নানান বার্তা।  ৪-৫ জনের একেকটি টীম ভাগ হয়ে পুরো গ্রামের প্রতিটি ঘরের দরজায় গিয়ে কথা বলছেন তৃণমূলের এসব মানুষদের সাথে যারা আদতে চলমান মহামারি সম্পর্কে ধারণাতীত কুসংস্কার কিংবা অবহেলাসূচক মনোভাবে কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধিই মানেন না।  তথ্য প্রদান শেষে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া স্বাস্থ্যবিধি না মানা নারী বা পুরুষকে পড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অত্যধিক সুরক্ষিত কাপড়ের মাস্ক।
  হাতে হ্যান্ড মাইক, ড্রাম, ফেস্টুন, স্ট্যান্ড ব্যানার আর সুরক্ষিত তিনস্তরের কাপড়ের মাস্ক নিয়ে দূর্গম পাহাড়-টিলা, চলাচল অনুপোযোগী পথ-ঘাট, খাল-ছড়া মাড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের এই দল ছুটে চলেছেন মানুষকে একটু সচেতন করার মানসে।  দিনভর ক্লান্তিকে শক্তিতে পরিণত করে স্বেচ্ছাসেবকদের এই দলটি মানুষকে করোনা মোকাবেলায় মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে নিয়ম মেনে হাত ধোয়া ও পরিস্কার থাকা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়গুলো বলার পাশাপাশি সবাই যেনো করোনা প্রতিরোধক টিকা গ্রহণ করেন সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন।  তথ্য পেয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠা কোনো কোনো নারী-পুুরুষকে নিবন্ধন করে দেয়ার মাধ্যমে সবাইকে নিবন্ধনের পদ্ধতি সম্পর্কে যেমন বলছেন, তেমনি যারা নিবন্ধন নিতে অপারগ তারা যেনো পরিচয়পত্র নিয়ে সরকার নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্র থেকে কোভিড-১৯ সুরক্ষায় টিকা গ্রহণ করেন সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
স্বপ্নবাজ মানবিক এই তরুণেরা হচ্ছেন সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ভোরের আলো’র চট্টগ্রাম উত্তর জোনের সদস্য।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা তথ্য অফিস এই কর্মসূচি আয়োজন করলেও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় ভোরের আলোকে।  আর সার্বিকভাবে এতে সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এর চট্টগ্রাম অফিসের কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট সেকশন।
ভোরের আলো চট্টগ্রাম উত্তর জোনের (হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড) দায়িত্বপ্রাপ্ত টীম লিডার মো. জিপন উদ্দিন জানান, ভোরের আলো চট্টগ্রাম উত্তর জোন শতাধিক যুব তরুণ-তরুণীর সমন্বয়ে গঠিত।  আমরা সবাই এখনো পড়ালেখায় যুক্ত।  এছাড়াও সাংবাদিকতাসহ নানান পেশায় যুক্ত কিছু উদ্যোমী তরুণ নিজেদের কাজের পাশাপাশি ভোরের আলো’র সদস্যভুক্ত হয়ে নানান মানবিক কর্মকাণ্ড করছি।  চলমান করোনা ভাইরাস মহামারির এমন দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে থাকছি আমরা।  বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি এখন আমরা চট্টগ্রাম উত্তর জেলার আওতাধীন হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডের প্রত্যন্ত এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দূর্গম এলাকায় গিয়ে সেখানকার মানুষগুলোর মাঝে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ক সচেতনতামূরক প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছি।  রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ উত্তর জেলার সবগুলো উপজেলায় পুরো আগস্ট মাস জুড়েই আমরা এমন প্রচার কার্যক্রম চালাবো।  কর্মসূচিতে আমরা মানুষকে তিনস্তর বিশিষ্ট করোনা মোকাবেলায় সহায়ক কাপড়ের মাস্কও বিতরণ করছি।  প্রতিটি এলাকায় ড্রাম বাজিয়ে যখন আমরা প্রচার কাজ চালাই, ঘরে ঘরে যাই তখন জানতে পারি যে- তারা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অবগতই নন।  কেউ কেউ জানলেও সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধিই মানেন না।  এমনকি করোনা প্রতিরোধী টিকা নিলে মানুষ মারা যায় কিংবা রক্ত সাদা পানি হয়ে যায়- এমন কথাও জানতে পেরেছি।
ভোরের আলো চট্টগ্রাম উত্তর জোনের কো-টীম লিডার রিফাতুন্নেসা নয়ন জানান, আমি প্রতিদিনই রাউজানের মদুনাঘাট থেকে কুয়াইশ-অক্সিজেন হয়ে ফটিকছড়িতে আসি।  কারণ আমার সংগঠন ভোরের আলো চায় আমরা যেনো একেবারেই দূর্গম এলাকার মানুষদের সচেতন করি।  ভালো কাজগুলো করতে গিয়ে কিন্তু আমার আসা-যাওয়ার কষ্টটা কিছুই মনে হয় না।
আইন বিষয়ে অধ্যয়ণরত তরুণী নয়ন জানান, আমরা যখন প্রচারে যাই-তখন অনেকেই মনে করেন আমরা মনে হয় কিছু (সহায়তা) নিয়ে এসেছি।  অনেকেই আবার আমাদের আক্রমণাত্মকভাবে বলেন- না খেয়ে মরার চেয়ে করোনায় মরলে অনেক ভালো।  ঘরে ভাত না থাকলে এতো নিয়মকানুন দিয়ে কি করবো- এমন নেতিবাচক ধারণাপোষণকারীদের যখন আমরা বুঝিয়ে সঠিক তথ্যগুলো দেই, যখন তিনি আশ্বস্ত হন এবং তার আচরণের জন্য লজ্জ্বা পাওয়ার মনোভাব ব্যক্ত করেন, তখনই মনে হয় আমাদের এই দূর্গম পথচলা বুঝি স্বার্থক হলো।
ফটিকছড়ির ২১ নম্বর খিরাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, আমার ইউনিয়নটি খুবই দূর্গম এবং অনেক বড়।  এখানে এই ধরণের প্রচার কার্যক্রম কখনোই হয় না।  দূর্গমতার কারণে সরকারি সেবাগুলো এখানে পৌঁছায় না।  আমার কাছে খুভ ভালো লেগেছে যে ভোরের আলো’র একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের দল আমার ইউনিয়নের দূর্গম মগকাটাগ্রামে এবং বড়ইতলীর কিছু অংশে প্রচার কাজ চালিয়েছে।  আমি তাদের বলেছি আরো কিছু এলাকা আছে সেখানেও তোমরা একটু আসো।  আমি কৃতজ্ঞতা জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে এমন একটি উদ্যোগে সহযোগিতা করায়।  ধন্যবাদ জানাই ইউনিসেফ বাংলাদেশকেও।  এমন কিছু উদ্যোগে সহযোগিতা পেলে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের শ্রম ও মেধা নিয়ে মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস রাখি।
ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সমন্বয়কারী মো. শফিকুল ইসলাম খান পেশায় সংবাদকর্মী।  ছোটবেলায় পথশিশু হিসেবে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী শফিকুল ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভোরের আলো।  নিজের অভিজ্ঞতাগুলোকে সামনে রেখে তিনি নানান মানবিক কাজ করে ইতোমধ্যেই দেশসেরা সংগঠক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন।  তিনি জানান, ভোরের আলো গত প্রায় ২০ বছর ধরে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোর-কিশোরী ও যুবজনগোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়ন, সুরক্ষা এবং পুনর্বাসনে কাজ করছে।  আমাদের সংগঠন স্থায়িত্বশীল জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিতভাবেই পাপেট প্রদর্শনী, জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনা-রাজু-মিঠুকে নিয়ে মাপেট প্রদর্শনী, কমিউনিটি থিয়েটার, পথ নাটক, ইন্টারঅ্যাকটিভ পপুলার থিয়েটারসহ মানুষকে বিনোদনের মাধ্যমে সচেতন করা যায়- এমন নানান মাধ্যম ব্যবহার করে কাজ করছে।  আমরা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই চট্টগ্রাম জেলা তথ্য অফিসকে এমন একটি কাজে আমাদের সম্পৃক্ত করায়। কৃতজ্ঞতা জানাই জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কে এমন কার্যক্রমের একটি পরিকল্পনা আমাদের দিয়ে বাস্তবায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ায়।
শফিকুল জানান, জেলা তথ্য অফিস এবং ইউনিসেফ চট্টগ্রাম অফিসের সিফোরডি সেকশনের সহযোগিতায় আমরা প্রথম পর্যায়ে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, মিরসরাইয়ের ২০টি এলাকায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্পন্ন করেছি।  দ্বিতীয় পর্যায়ে রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ উল্লেখিত উপজেলাগুলোর আরো ২২টি এলাকায় আমরা এই প্রচার কার্যক্রম চালাবো।  চট্টগ্রাম জেলা তথ্য অফিস পুরো কার্যক্রমটি আয়োজন করছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় তথ্য অফিসের উপ-পরিচালক সাইদ হাসান জানান, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেলা তথ্য অফিস ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) সিফোরডি এর আওতায় ‘ড্রাম বাজিয়ে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম’টি পরিচালনা করা হচ্ছে।  আমরা এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নে ভোরের আলোকে দায়িত্ব দিয়েছি।  এছাড়াও জেলা তথ্য অফিস নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে শহর-গ্রামে করোনা মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ক পথপ্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।  এই কার্যক্রম চলমান থাকবে বলেও তিনি জানান।

ডিসি/এসআইকে/আরএআর