জন্মনিবন্ধন নিয়ে চরম দুর্ভোগে নাগরিক

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
নগরের ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুপা আক্তারের বয়স ১৯ নভেম্বর পড়বে ১৮ তে।  নগরের ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের এই শিক্ষার্থীর প্রয়োজন নিজের অনলাইন জন্মনিবন্ধন।  তার জন্মনিবন্ধনটি এখন আর কাজে আসছে না নতুন নিয়মের কারণে।  অগত্যা দোকানে গেলেন জন্মনিবন্ধন ফরম পূরণ করতে।  কিন্তু সেখানে সমস্যা বাঁধলো তার বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন না থাকার কারণে।  গত ৪ নভেম্বর তার কলেজ থেকে তাকে ইউনিক আইডির জন্য অনলাইন জন্মনিবন্ধন জমা দিতে বলা হলেও নিবন্ধন শর্ত জটিলতায় সে এটি করতে পারেনি এখনো।  রুপা জানায়, আমার জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে সেখানে মা ও বাবার জন্মনিবন্ধনও দিতে হচ্ছে।  বাবার জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে দাদার জন্মনিবন্ধন নাম্বার চাচ্ছে যা এখন আর সম্ভব নয়।  বাবার আইডি কার্ড থাকলেও সেখানে তা দিয়ে হচ্ছে না।  অন্যদিকে একই সমস্যা মায়ের জন্মনিবন্ধন নিয়েও।  আমার মায়ের টিকা কার্ড বা আইডি কার্ডও নেই।  ফলে সেটাও হচ্ছে না।  একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এখন চরম বিপদে আছি।  এরমধ্যেই আমার প্রায় ৫০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।  জন্ম নিবন্ধনের শর্তগুলো আরো সহজ করা উচিৎ।  বিশেষ করে যারা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী তারা যাতে বিপদে না পড়ে সে জন্য স্কুল-কলেজের ডকুমেন্টস দিয়ে যাতে নিবন্ধন করা যায় সেটার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
নগরের আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ এলাকার রিমা ও সায়মা আক্তার দুই বোন। স্কুল থেকে অনলাইন জন্মনিবন্ধন চাওয়া হয়েছে তাদের। মা সিরাজী আকতার দুই মেয়েকে নিয়ে একবার ছুটছেন ওয়ার্ড অফিসে, একবার দোকানে। সার্ভার সমস্যার কারণে কাজ করতে যেমন অসুবিধা হচ্ছে, তেমনি জন্ম নিবন্ধনের শর্তানুসারে ডকুমেন্টস তার নেই। ইতোমধ্যে প্রায় ৯০০ টাকার মতো খরচ হয়েছে তাঁর। কিন্তু নিবন্ধন ফরমই পূরণ করতে পারেননি তিনি। ত্যাক্ত-বিরক্ত-চিন্তিত সিরাজী আকতার দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, সার্ভার লোড নিতে না পারলে এতো আয়োজন আর এতো শর্ত কেন? এই এক জন্ম নিবন্ধনের জন্য আজ তিনদিন হয়রানির শিকার হচ্ছি। একটা টেনশন মাথায় থাকছে। টাকাও খরচ যাচ্ছে। যে সেবা নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলে সে সেবার উদ্যোগ সরকার নেয় কেন?
আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল হক। তার ৬ সন্তান। ছোট দুই ছেলের জন্য জন্মনিবন্ধন করতে মাস দেড়েক আগে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড অফিসে যান তিনি। সেখান থেকে দায়িত্বশীলরা তাকে জানান, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন অবশ্যই থাকতে হবে। এরপর সিরাজুল হক নিজের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। গত ১১ অক্টোবর ফি জমা দেন তিনি। অন্তত ৫ দিন ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট শাখায় যান। কিন্তু জন্মনিবন্ধন পাননি। সিরাজুল হক-রুপাদের মতো সারাদেশেই সাধারণ মানুষ জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করার শর্তে জটিলতা রয়েছে। রয়েছে সনদ প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা। সরকারি ফির বাইরেও নেওয়া হচ্ছে অর্থ। পাসর্পোট তৈরি, বিয়ে ও জমি রেজিস্ট্রেশন, শিশুদের করোনার টিকা এবং স্কুলে ভর্তিসহ ১৭টি সেবার ক্ষেত্রে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ‘বাধ্যতামূলক’ ও জরুরি এই সনদ পেতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের জনবল সংকট, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও কেন্দ্রীয় সার্ভারে নানা জটিলতার কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা। সম্প্রতি দেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হলে জন্মনিবন্ধনের সনদ উত্তোলনের হার বেড়ে যায়। কিন্তু এই সনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অভিভাবকরা ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকাও। আবার অনেকের জন্মসনদ সংশোধন করতে হচ্ছে। সেখানে ভোগান্তি আরও বেশি। জন্মনিবন্ধন উত্তোলন ও সংশোধনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালালচক্র।
সারাদেশেই জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে মানুষকে নাজেহাল হতে হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি চরম শারিরীক ও মানসিক দুর্ভোগও পোহাচ্ছেন নাগরিকেরা। ভোগান্তির কারণে অনেকেই জন্মসনদ নিতে যাচ্ছেন না। সনদ পেতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। এসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেকেরই হাঁসফাঁস অবস্থা। যাদের জন্ম ২০০১ সালের পর তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। একটি ওয়ার্ড অফিসে একটিমাত্র কম্পিউটারে হাজারো জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে যেমন মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে, তেমনি অতিরিক্ত টাকা না দিলে জন্মসনদ দিতে গড়িমসি করছে জন্মনিবন্ধন অপারেটরসহ সংশ্লিষ্টরা। কোথাও কোথাও জন্মনিবন্ধনকারীদের কাছে থেকে নেয়া অর্থ ভাগ-বাটোয়ারায় যুক্ত আছেন খোঁদ জনপ্রতিনিধিরাও।
স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে আসা সালমা বেগম নামের এক নারী জানান, স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই জন্মনিবন্ধন আছে। তবে একজনের ইংরেজিতে, আরেক জনেরটা বাংলা। এ কারণে তারা আবেদনই করতে পারছেন না। সন্তানেরটাও হচ্ছে না।
সিটি কর্পোরেশনের জন্মনিবন্ধনের আবেদনপত্র জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা এক কর্মী বলেন, ‘মা-বাবার নিবন্ধন বাংলায় হলে সন্তানও বাংলায় জন্মনিবন্ধন সনদ পাবে। আর মা-বাবার সনদ ইংরেজিতে হলে সন্তানেরটাও ইংরেজি হবে। আর মা-বাবারটা আলাদা হলে তারা আবেদনই করতে পারবেন না। দুজনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এ ধরনের সমস্যা অনেক হচ্ছে’।
নাগরিকদের অভিযোগ, দালালদের হাতে অতিরিক্ত টাকা দিলেই দ্রুত সনদ মেলে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সার্ভার সমস্যার কারণেই সনদ দিতে দেরি হয়।
জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে অনলাইন আবেদনপত্রের সাথে মা-বাবার জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা বয়স প্রমাণের সনদপত্র, স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র বা হোল্ডিং নাম্বারের কাগজ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে শিশুকার্ড (ইপিআই কার্ড) সংযুক্ত করে জমা দিতে হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ নতুন জন্মনিবন্ধন সনদে ১০০ টাকা, সংশোধনীতে ২০০ টাকা ও প্রতিলিপির ক্ষেত্রে ১০০ টাকা ফি (রিসিটের মাধ্যমে) নেয়। তবে অনেকের কাছ থেকে ১০০০ টাকা নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষর না নিয়ে ফরমই পূরণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার জনপ্রতিনিধিরা ব্যস্ত থাকার কারণেও মানুষ সনদটি পেতে দুর্ভোগে পড়ছেন বলে জানিয়েছেন। সারাদেশেই একই অবস্থা।
হঠাৎ করে কেন বেড়েছে জন্মনিবন্ধন গ্রহণের হার?
সম্প্রতি সরকার ১৬টি সেবায় বাধ্যতামূলক করেছে অনলাইন জন্মনিবন্ধন। পুরনো জন্মনিবন্ধন যাদের আছে তারাও পড়ছেন সংকটে। হাতে লেখা, অনলাইনে না থাকা এবং পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধনে পৃথক ভাষায় লিবিপদ্ধ থাকায়ও সমস্যা হচ্ছে। জানা গেছে, পাসপোর্ট তৈরি, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার তালিকা তৈরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি ও রপ্তানি লাইসেন্স, গ্যাস, পানি, টেলিফোন এবং বিদ্যুৎ সংযোগের অনুমতি, করদাতা শনাক্তকরণের নম্বর, ঠিকাদারি বা চুক্তির লাইসেন্স, ভবন নকশার অনুমোদন, ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তি এবং মোটরযানের নিবন্ধন পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জনবল সংকট, অদক্ষ জনবল, দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যবহার, ইন্টারনেটের ধীরগতি, কেন্দ্রীয় সার্ভারে ত্রুটি, সেবাদানকারীর দুর্ববহার, তথ্য প্রদানে অনীহা এবং নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে সারাদেশের ‘জন্মনিবন্ধন সনদ’ কার্যক্রম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দুর্ভোগ লাগবে সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম সহজ এবং সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভাগীয়, সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ইউনিয়ন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তাদের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এসব টাস্কফোর্স ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী আমাদের সময়কে বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসক, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা যেন জনসাধারণকে জন্মনিবন্ধনে উদ্বুদ্ধ করে তার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভোগান্তি নেই। তবে কিছু কিছু অসুবিধা আছে। আমরা অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগোচ্ছি’।
মুস্তাকীম বিল্লাহ বলেন, ‘মানুষ সারাবছর জন্মনিবন্ধন করে না। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এসে সবাই একসঙ্গে নিবন্ধন করতে চায়। ফলে এক সঙ্গে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে সার্ভার অনেক সময় বেশি লোড হয়ে যায়। একটু সমস্যা তৈরি হয়।’ শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই জন্মনিবন্ধন করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
জন্মনিবন্ধন সংশোধনে ভোগান্তির বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ‘সংশোধনে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভোগান্তিই নেই। অনলাইনে ঘরে বসে সহজেই সংশোধন করা যায়’। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে এতদিন সচেতন ছিল না। এখন সচেতন হচ্ছে। কারণ ১৬টি সেবা পেতে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মসনদ লাগে’।
জন্মনিবন্ধনে নতুন করে করতে কিংবা সংশোধনে কয়েকশ গুণ বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ রকম হলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেন। আমরা ব্যবস্থা নেব। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে খুবই সামান্য পরিমাণে ফি দিতে হয়। এখন যদি দালালচক্র অতিরিক্ত টাকা-পয়সা নেয়, সেটি আমাদের জানান’।
রেজিস্ট্রার জেনারেল আরও বলেন, ‘আমাদের টেকনিক্যাল কাজের লোক মাত্র দুজন। তাদের মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। এ জন্য টেকিনিক্যাল সাপোর্ট তুলনামূলকভাবে কম। আমরা জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি’। তিনি বলেন, ‘অনেকের নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন রয়েছে। আমরা সেসব নিবন্ধন ব্লক (বন্ধ) করে দেব’।

ডিসি/এসআইকে/আরসি