হুইপ সামশুলের নির্বাচনী ধান্দা : ‘১০ লাখ টাকা ফাইয়ি, তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা’

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের টিকিট পাবেন কারা, সেটি নির্ধারণ করতেন ওই আসনের সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
কাউন্সিলর পদে দলীয় টিকিট পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি আব্দুল খালেকের কাছ থেকে নেন ১০ লাখ টাকা।  খালেককে আশ্বস্ত করে হুইপ বলেন, ‘১০ লাখ টাকা ফাইয়ি (পেয়েছি)।  তোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।  তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা, তোরটা হয়ে গেছে।  প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে তোর নাম চলে গেছে’।
হুইপের মুখ থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে সত্যিই নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল খালেক।  কিন্তু যে কথা, সেই কাজ হয়নি।  আওয়ামী লীগের টিকিটে মনোনয়ন পান বিএনপি ঘরানার মো. নাসির।  ক্ষুব্ধ আব্দুল খালেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, নাসিরের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা পেয়ে নিজ ঘরের খালেককেই ভুলে যান হুইপ।  ওই নির্বাচনে নাসিরকে বিজয়ী করে আনে হুইপের লোকজন।
ভোটের পর খালেককে কিছু টাকা ফেরত দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন হুইপ সামশুল।  মনোনয়নের বিনিময়ে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত একটি অডিও রেকর্ডে খালেকের উদ্দেশে হুইপকে আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শোনা যায়, ‘গোটা পটিয়ার মানুষ কইয়ে তোর কোনো জনপ্রিয়তা নাই।  এ জন্য তোকে নমিনেশন দেওয়া যায়নি’।  অর্থ লেনদেনের প্রসঙ্গ উঠার পর হুইপ বলেন, ‘তোর খরচ লাগলে কিছু টাকা নিয়ে যা’।
আব্দুল খালেক এ সময় হতাশ কণ্ঠে হুইপকে বলেন, ‘আঁর জীবন তো ধ্বংস করি ফালাইয়ুন বদ্দা।  আঁই ত আর রাজনীতিত নাই।  আঁরে ত অনে পথত নামাই ফালাইয়ুন।  গোডা পটিয়ার মানুষ হষ্ট ফাইয়ে (আমার জীবন তো ধ্বংস করে দিয়েছেন ভাই।  আমি এখন আর রাজনীতিতে নেই।  আমাকে তো পথে নামিয়ে দিয়েছেন।  পুরো পটিয়ার মানুষ কষ্ট পেয়েছে)’।
হুইপ সামশুলের মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালেক বলেন, ‘ওনার (হুইপ) চাহিদামতো ১০ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিলাম।  টাকা পেয়ে উনি ফোনে বললেন, তোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।  তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা, তোরটা হয়ে গেছে।  প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে তোর নাম চলে গেছে।  পরে আরেক প্রার্থীর কাছ থেকে বেশি টাকা পেয়ে আমাকে আর দেওয়া হয়নি।  এমনকি আমাকে অপহরণেরও চেষ্টা করা হয়।  উনি টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না’।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এভাবেই টাকার বিনিময়ে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে আসছেন।  কোনো দলীয় সীমাবদ্ধতা নেই, যে কেউই নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে পারেন।  এ জন্য হুইপের কাছে পাঠিয়ে দিতে হয় পদ বুঝে লাখ থেকে কোটি টাকা।  প্রার্থী বিএনপি, জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগ- যে দলেরই হন, টাকার অঙ্ক যাঁর যত বেশি তিনিই পান মনোনয়ন।  হুইপপুত্র শারুন ও ভাই নবাবের অনুমতি ছাড়া নির্বাচনে দাঁড়ালেই নেমে আসে হামলা-মামলাসহ নানা অত্যাচার।  এ কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হুইপ সামশুল হকের মনোনয়ন বাণিজ্যে পটিয়ায় আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।  পটিয়ায় নির্বাচন মানেই টাকার খেলা।  প্রার্থী যে দলেরই হোক, টাকা হলেই মেলে আওয়ামী লীগের দলীয় নমিনেশন।  পটিয়ার ১৭টি ইউনিয়ন আর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডজুড়ে নির্বাচন মানেই মনোনয়ন বাণিজ্য।  একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেন হুইপ।  আর শেষে যিনি বেশি টাকা দেন তিনিই মনোনয়ন পান।  বাকিরা টাকা ফেরত চাইলে হতে হয় গুম, নয়তো নেমে আছে নানামুখী নির্যাতন।
দলীয় নেতা-কর্মীদের আরও অভিযোগ, হুইপ প্রতিনিয়ত নানা অপকর্ম করে চলেছেন।  কিন্তু বরাবরই থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সামশুল হক ছিলেন সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকার ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।  তিনি সুকৌশলে বনে যান জাতীয় সংসদ সদস্য।  হন সরকারদলীয় হুইপ।  পদের প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক করে চলেছেন নানা অপকর্ম।  হুইপ সামশুলের মতো বিতর্কিত ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হওয়ায় নিজেদের দুর্ভাগা বলছে পটিয়াবাসী।
অন্যদিকে হুইপের প্রশ্রয়ে তাঁর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনও বেপরোয়া।  এ যেন ‘বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া’।  শারুন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এসএসসি পাস কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।  তারা বলছেন, অস্ত্র চালনা, স্মাগলিং কিংবা গ্যাং তৈরিতে পারদর্শী হুইপপুত্র।  অভিযোগ উঠেছে, হুইপের পরিবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের অভিযোগ, হুইপকে একসময় তাঁরা বিচ্ছু সামশু নামেই চিনতেন।  তাঁর অনেক ইতিহাস আছে।  চুরি করেছেন।  জেল খেটেছেন।  হুইপের চৌদ্দ গোষ্ঠীতে কেউ আওয়ামী লীগ করেনি।  পটিয়া আওয়ামী লীগের যে কমিটি হয়েছে, তারা বিভিন্ন দলের লোক।  আজ বিএনপি-জামায়াত থেকে এনে আওয়ামী লীগে ঢোকানো হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নমিনেশনপ্রত্যাশী আরেক ব্যক্তির অভিযোগ, তিনি নিজে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন হুইপকে।  কিন্তু বেশি টাকার বিনিময়ে হুইপ মনোনয়ন দিয়েছেন তাঁর প্রতিপক্ষকে।  এ সময় হুইপ বলেছেন, টাকা ছাড়া নির্বাচন হবে না।  তিনি আরো বলেন, এর আগের নির্বাচনে হুইপ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন।  টাকা না দিলে মনোনয়ন দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।– সূত্র: কালের কণ্ঠ ও বাংলানিউজ

ডিসি/এসআইকে/আরএআর