ঢাবির ট্রেজারারের বিদেশি এমবিএ সনদ ভুয়া!

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম (এআইএস) বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বিদেশি ভুয়া মাস্টার্স (এমবিএ) ডিগ্রির সনদ ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সনদ ব্যবহারের ফলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি সহজ হয় তাঁর। যদিও এ অভিযোগ স্বীকার করেননি ট্রেজারার।
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত এই জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন। সমকাল অনুসন্ধানে দেখেছে, দেশটিতে ওই সময়ে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। ২০০৮ সালে এই নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে সনদ বিক্রিসহ নানা অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের ৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এটি বন্ধ করে দেয়।
অস্ট্রেলিয়াতে ‘দি ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসেল, অস্ট্রেলিয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিসম্পন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বর্তমানে বিশ্বের সেরা ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটির অবস্থান ১৯২তম। সেটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একাডেমিক কার্যক্রম বা শাখা নেই, কখনও ছিল না।
অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কুমিল্লা বোর্ড থেকে ১৯৭৩ সালে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯৭৮ সালে (১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে বিকম (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান এবং ১৯৭৯ সালে (১৯৮২ সালে অনুষ্ঠিত) এমকম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ জমা দেন। বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস (আইসিএমএ) থেকে সিএমএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। অধ্যাপক মমতাজ লেকচারার হিসেবে ১৯৮৪ সালে প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে সহকারী অধ্যাপক ও ১৯৯৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক হন। ২০০৪ সালে পূর্ণ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য কয়েকটি দায়িত্বও পালন করেছেন।
স্নাতক থেকে শুরু করে পরবর্তী যে কোনো বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি বাংলাদেশে ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ‘ইকুইভ্যালেন্ট সার্টিফিকেট’ বা ‘সমমান সনদ’ অনুমতি নিতে হয়। ইউজিসি সূত্র থেকে জানা যায়, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিনের এমবিএ ডিগ্রির ক্ষেত্রে কমিশন কোনো সমমান সনদ দেয়নি। বিদেশি ডিগ্রির সমমান সনদ প্রদানের কাজটি করে ইউজিসির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগ। এ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশ থেকে কোনো ডিগ্রি আনলেই তা ইকুইভ্যালেন্ট বা সমমান হয় না। এর জন্য বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হয়। ইউজিসির নির্ধারিত একটি কমিটির দ্বারা যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশের সঙ্গে সমতার উপযোগী হলে ডিগ্রি ব্যবহারের অনুমতি সনদ দেয় ইউজিসি।
জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ভুয়া ডিগ্রির অভিযোগ থাকলে তা যাচাই করা এখন সহজ। ইউজিসি থেকে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট ও ভিসা দেখতে চাওয়া হয়। সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-মেইল করে নির্দিষ্ট একাডেমিক বছরে ওই শিক্ষার্থীর ভর্তি ও পাঠ গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। সেখান থেকে ফিরতি মেইল এলে ভুয়া নাকি আসল নির্ণয় হয়ে যায়। তিনি বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি অস্তিত্বহীন হয়, সেখানে তো আর সনদ যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকলেও সংশ্নিষ্ট বিভাগ ও কোর্সের সরকারি অনুমোদন না থাকলে সেই সনদও অবৈধ।
ইউজিসি সচিব বলেন, পদোন্নতিতে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় একেক ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে একাধিক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও পিএইচডি প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে একাধিক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও দুই বিষয়ে স্নাতকোত্তর থাকলে বাড়তি পয়েন্ট যোগ হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘আমি অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিটি নিয়েছি। সশরীরে যুক্তরাষ্ট্রে যাইনি। তাহলে তো আমার ছুটি থাকত। এটি আমি বিশ্ববিদ্যালয়কেও জানিয়েছি’। কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসলের অস্তিত্বই ছিল না- এ কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আমি তা জানি না, এমন হওয়ার কথাও নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটিও আমার জানা নেই’।
তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছিল। তারই একটি এটি। আমার বিভাগের প্রধানের অনুমতি নিয়েই আমি সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। এত দিন পর এ নিয়ে কথা উঠছে কেন, বুঝতে পারছি না’।
এ বিষয়ে সন্ধান করলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ২০০৩ সালে বাংলাদেশে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, স্টাডি সেন্টার ও ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার অনুমতি ছিল না। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মোনাশ কলেজকে (অস্ট্রেলিয়া) স্টাডি সেন্টার করার অনুমতি দেয় ইউজিসি। আর কারও কোনো অনুমতি নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এটা শুনে মেলাতে পারছি না। আমার বুঝে আসছে না, ওনার তো একটা মাস্টার্স ডিগ্রি ছিলই। বিষয়টি গ্রহণ করাও আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। পুরোটা খতিয়ে না দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করাও কঠিন’।

ডিসি/এসআইকে/এসপি