তিনিই মহানায়িকা!

বিনোদন ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
‘আমি আপন করিয়া চাহিনি তবু তুমি তো আপন হয়েছো, জীবনের পথে ডাকিনি তোমায়, সাথে সাথে তুমি রয়েছো’।  ‘মেঘ কালো’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের ঠোঁট মিলানোতে আশা ভোঁসলের কণ্ঠে এ যেন এক মন ভুলানো গান।  কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এ গানটি সুচিত্রা সেনের পছন্দের একটি গান ছিলো।  ভারতীয় বাংলা চলচিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছিলেন তিনি।  বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ম্যাডাম’ এবং অতঃপর মহানায়িকা খেতাব- এ এক বড় গল্প।  আসলে সুচিত্রা সেন শুধু নাম নয়, বিশাল এক অধ্যায়ের চেয়েও বেশি কিছু।
মূলত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।  তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।  রূপালি পর্দার উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও তুমুল দর্শকপ্রিয়।
সুচিত্রা সেন জন্মসূত্রে বাংলাদেশি।  ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলার সদর পাবনায় সুচিত্রা সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  তার বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত সেন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রাম।  তার নাম রাখা হয়েছিল রমা দাশগুপ্ত।  বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ।  তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা।  সুচিত্রা সেন পাবনা শহরেই পড়াশোনা করেছিলেন।  তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।
বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।  সুচিত্রা-উত্তম জুটির রসায়ন আপামর বাঙালিকে মুগ্ধ করেছিল অভূতপূর্বভাবে, যা আজও স্মরণীয়।  ‘হারানো সুরে’ এক নারীর তিতিক্ষা ও সহনশীলতাকে অত্যন্ত সুচারুভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।  পলাশপুরে বিয়ের রাতে টিলার উপর অজস্র ফুলের মাঝে বসে গালে হাত দিয়ে রমা তার কোলে স্বামীকে শুইয়ে ‘তুমি যে আমার’ গাইছে, এ দৃশ্য বাঙালি ভুলতে পারেনি এখনো।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর গানেরও রয়েছে বিশাল সম্ভার।  ‘ঢুলি’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’, ‘শিল্পী’, ‘চন্দ্রনাথ’ অসংখ্য সিনেমা আর বিরল গান।  সেসব গানের শিল্পীরা যে দিকপাল, তার কোনো সন্দেহ নেই।  কিন্তু অসামান্য ঠোঁট মেলানোর গুণে সেগুলো মহানায়িকারই গান হয়ে গিয়েছে।
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন।  ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।  শোনা যায়, ২০০৫ সালে তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।  কিন্তু সুচিত্রা সেন জনসমক্ষে আসতে চান না বলে এই পুরস্কার গ্রহণ করেননি।  ২০১২ সালে তাকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবিভূষণ প্রদান করা হয়।
সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবিটি মুক্তি পায়নি।  ১৯৫২ সালে শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়।  সুচিত্রা উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন।  এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।  ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য লাভ করে এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি একের পর এক হিট ছবি উপহার দিতে থাকেন তারা।
বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি পরবর্তী ২০ বছরে ছিলেন আইকন স্বরূপ।  ১৯৫৫ সালের ‘দেবদাস’ ছবির জন্য সুচিত্রা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি।  উত্তম কুমারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী।
১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে তার অভিনীত সবকটি ছবিই ব্যবসা সফল।  স্বামী মারা যাওয়ার পরও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন।  এদের মাঝে ছিল হিন্দি ছবি ‘আন্ধি’।  এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।  বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে ইন্দিরা গান্ধী থেকে।
১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়।  তাদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেনও একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী।  ১৯৫২ সালে সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হন।
‌‘আন্ধি’ ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং তার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করা সঞ্জীব কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন।  ১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন।  এরপর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন।
ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে সুচিত্রা সেন যেনো মোহিনি হাসি, সজল দৃষ্টি আর রহস্যময় ভঙ্গিমার এক চিরন্তন প্রতিমা।  এই মহানায়িকা রূপালি পর্দার জ্বলমলে জীবনকে বিদায় জানানোর পর আর মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হননি।  ফলে যৌবন পরবর্তী সময়ে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন তা আর কেউ জানে না।  শুধু তাই-ই নয় ৩০ বছরের বেশি সময় বাড়ির বাইরে বের হননি সুচিত্রা।  এমনকি ঘরের মধ্যেও কোনো কায়িক পরিশ্রম করেননি।  শুয়ে-বসে থেকেছেন বছরের পর বছর।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা প্রেমের ছবিকে স্বর্ণযুগে পৌঁছে দিয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা চিরসবুজ জুটি।  ১৯৫০ সাল থেকে প্রায় ২৫ বছর কোটি বাঙালির হৃদয়ে ঝড় তুলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পর্দার অন্তরালে।  ঠিক কোন অভিমানে এ বাংলার মেয়ে সুচিত্রা ১৯৭৮ থেকে ২০১৪ প্রায় তিনটি যুগ পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন- শেষ পর্যন্ত তা হয়তো অজানাই থেকে গিয়েছে।
২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে স্বশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যাওয়ায় আপত্তি জানানোর কারণে তাকে পুরস্কার দেয়া হয়নি।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এ কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যু হয়।

ডিসি/এসআইকে/ইউএস