হালদায় রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ

হাটহাজারী প্রতিনিধি >>>
২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ২০০ কেজি, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৪০ কেজি, ২০১১ সালে ১২ হাজার ৬০০ কেজি, ২০১০ সালে ৯ হাজার কেজি, ২০০৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ কেজি, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৪০০ কেজি, ২০০৭ ২২ হাজার ৩১৪ কেজি এবং ২০০৬ সালে ৩২ হাজার ৭২৪ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন পোনা ব্যবসায়ীরা; এ তথ্য হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির।  তবে সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করেছেন মৎসজীবীরা।  দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হালদা নদীতে রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ ডিম ছাড়ে গত বৃহস্পতিবার (২১ মে) রাত ১২ টার দিকে। এরপর থেকেই ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে ওঠেন নদীর দুই পাড়ের (রাউজান-হাটহাজারী) শত শত ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা।  তারা গত বৃহস্পতিবার থেকে ডিম সংগ্রহের প্রত্যাশায় নৌকা, বালতি, জাল নিয়ে নদীতেই অবস্থান করছিলেন।  ডিম সংগ্রহের পর থেকে শুরু হয়েছে রেণু ফোটানোর কর্মযজ্ঞ।  ব্যস্ত সময় পার করছেন বংশ পরম্পরায় অভিজ্ঞ ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা।   আজ শুক্রবার (২২ মে) অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৪৩৬ কেজি পোনা সংগ্রহে সক্ষম হন এখানকার তালিকাভুক্ত ডিম সংগ্রহকারী মৎসজীবীরা।
গত বৃহস্পতিবার রাত ১২ টার দিকে জোয়ারের সময় মা-মাছের কিছু নিষিক্ত ডিম পেলেও পরের দিন আজ শুক্রবার (২২ মে) সকাল সাড়ে ৭টা থেকে পুরোদমে ডিম ছেড়েছে মা-মাছগুলো।  যার পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি।  মৎস্য অধিদপ্তর, হালদা রিভার রিচার্স সেন্টার ও হালদায় প্রকল্প কাজে নিয়োজিত এনজিও সংস্থা আইডিএফসহ তিনটি দফতরের সমন্বিত একটি দলের কর্মকর্তারা নিষিক্ত ডিমের এই পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুহুল আমিন।
নদীর আবহাওয়াগত পরিবেশ অনুকূলে থাকায় মা-মাছের দেয়া নিষিক্ত ডিম বংশ পরম্পরায় অভিজ্ঞ, দক্ষ, পারদর্শী প্রায় ৬১৫ জন ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবী ২৮০টি নৌকায় ডিম ধরার মশারি জাল, বালতিসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদার নদীর বুকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষে ডিম সংগ্রহকারীরা মা-মাছের নিষিক্ত আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পেরে আনন্দিত।  হালদাপাড়ে রীতিমতো ঈদ উৎসব শুরু হয়েছে।  এছাড়া হালদা নদীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করা ছিল হালদা ইতিহাসে বিরল- জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হালদা গবেষক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া।
বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে হালদা নদীর আজিমের ঘাটা থেকে গড়দুয়ারা পর্যন্ত ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা নমুনা ডিম সংগ্রহ করে।  এরপর শুক্রবার সকাল থেকে ডিম আহরণের নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদার হাটহাজারী ও রাউজান অংশের রামদাশ মুন্সীর হাট, আমতুয়া ও নাপিতের ঘাট এবং দুপুরের পর থেকে আজিমের ঘাট থেকে গড়দুয়ারা নয়াহাট পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় উৎসবমূখর পরিবেশে ডিম সংগ্রহকারীরা সবচেয়ে বেশি মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন।  এছাড়া রাউজান উপজেলার কাগতিয়া, খলিফার ঘোনা, পশ্চিম গহিরা অংকুরী ঘোনা, বিনাজুরী, সোনাইর মুখ, আবুরখীল, খলিফার ঘোনা, দক্ষিণ গহিরা, মোবারকখীল, মগদাই, উরকিচর এবং হাটহাজারী গড়দুয়ারা, সিপাহির ঘাট, উত্তর মাদার্শা, মদুনাঘাট ইত্যাদি এলাকায় ডিম পাওয়া যায়।
হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবী আবু জাফর, রাউজানের অংকুরী ঘোনা এলাকার রাজিব বড়ুয়া জানান, শুক্রবার সকাল থেকে নদীতে মা-মাছ ডিম ছাড়লেও দুপুরের পর থেকে ডিমের পরিমাণ বাড়তে থাকে।  নৌকায় করে মৎস্যজীবীরা মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন।  কেউ এক বালতি, কেউ ২-৩ বালতি, আবার কেউ সর্বোচ্চ ১২ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছে।  প্রতি বালতিতে ১৫ কেজির মত ডিম ধারণ ক্ষমতা রয়েছে।
এদিকে, মা-মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পর রেণু পরিস্ফুটনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে হাটহাজারী উপজেলার শাহমাদারি, মাছুনাঘোণা, মদুনাঘাট ৩টি সরকারি হ্যাচারি ও ১৬৭টি কুয়া প্রস্তুত করা হয়েছে।  এছাড়া স্থানীয়রা সনাতন পদ্ধতিতে সংগৃহীত ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের আরও শতাধিক কুয়া তৈরি করেছে।  অন্যদিকে মৎস্যজীবীরা হ্যাচারিগুলোতে ডিম সংগ্রহের পর রেণু পরিস্ফুটনের জন্য নিয়ে যেতে শুরু করেছেন।  সময় যত বাড়বে, ডিমের পরিমাণ তত বাড়বে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি।
অন্যদিকে, সংগৃহীত মা-মাছের নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ বেশি হওয়ায় হালদা পাড়ে কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।  এতে করে প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা আতংকে ভুগছেন। কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতার তৎপরতা সম্পর্কে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) ফারহানা লাভলী জানান, এই রকম কোনো কিছু আমি দেখিনি।  আমরা সার্বক্ষণিকভাবে হালদা পাড়ে অবস্থান করছি।  লকডাউনের মধ্যে এ রকম কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।  যদিও এরকম কোনো কিছু দেখা যায় তাহলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বয়ে গেছে।  এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটা নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।  সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ স্মরণাতীতকাল থেকে ডিম ছেড়ে আসছে।  মা-মাছের দেয়া নিষিক্ত এসব ডিম মৎস্যজীবীরা সংগ্রহ করে পরে তা কয়েক দফায় বিকিকিনি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন।  অপার এই জীববৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম রূপালী খনি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে চলেছে বহু বছর ধরে।
                               ১৪ বছরের রেকর্ড ছাড়ানোর নেপথ্যে
শুক্রবার হালদার ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীরা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ডিম আহরণ করেছেন বলে জানা গেছে।  মৎস্য অধিদফতর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) হালদা রিসার্চ ল্যাব ও উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফের তিনটি টিম এবার মা-মাছের ডিম সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে এমন তথ্য জানান।  ২৮০টি নৌকায় ৬১৫ জন ডিম সংগ্রহকারী এবার মাছের ডিম সংগ্রহ করেছেন।  সব মিলে তারা এবার ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন।  যা বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে রেকর্ড পরিমাণ ডিম আহরণের পর হালদার দু’পাড়ের ঘরে ঘরে চলছে ‘ঈদ আনন্দ’।  হালদা পুরনো রূপে ফিরে যাওয়ায় খুশি ডিম আহরণকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলে।  সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণেই হালদা হারানো যৌবন ফিরে পাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
হালদার ডিম সংগ্রহকারী গড়দুয়ারা এলাকার মৎস্যজীবী লিয়াকত সওদাগর বলেন, অনেক বছর পর হালদায় এতো ডিম পাইলাম।  এবার প্রচুর ডিম সংগ্রহ করেছি। আমার ৮টি নৌকায় প্রায় ৫১ বালতি মা-মাছের দেয়া নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেছি।  এবারের মা-মাছের দেয়া ডিমগুলো বেশ পরিপুষ্ট।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হালদা গবেষক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, নানা মুখী পদক্ষেপের কারণে হালদা ধীরে ধীরে পূরণে রূপে ফিরে যাচ্ছে।  গত ৪-৫ বছর ধরে হালদায় ডিম আহরণের পরিমাণ বাড়ছে।  এ বছর তো নিকট অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।  যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।  তিনি আরও বলেন, হালদায় দূষণ সৃষ্টি করা দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায়, লকডাউনের কারণে নদী তীরের শিল্প প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ থাকায়, বালুবাহী ড্রেজার চলাচল বন্ধ থাকায় এবং মা মাছ নিধন বন্ধে অভিযান জোরদার হওয়ায় এবার বেশি ডিমের প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, হালদাকে আগের রূপে ফেরাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানান পদক্ষেপ নেয়া হয়।  গত এক বছরে হালদার মা মাছ রক্ষা করতে ১০৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে।  ধ্বংস করা হয়েছে ড্রেজার, ঘেরা জাল, বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করা পাইপ ও নৌকা।  সবার সম্বিলিত প্রচেষ্টায় হালদা পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে।  তিনি আরও জানান, হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে ঈদের আনন্দ।  তারা ডিম সংগ্রহের পর থেকে রেণু ফোটানোর কর্মযজ্ঞতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।  যা দেখে সত্যিই আমি অভিভূত।
এদিকে ডিম ছাড়ার পর মা-মাছগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় যাতে কেউ মাছ শিকার ও কৃত্রিম রেনু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে বলেও ইউএনও রুহুল আমিন জানান।

ডিসি/এসআইকে/এমএমইউএম