করোনা পরিস্থিতিতেও কিভাবে বাংলাদেশে রেমিটেন্স ও রিজার্ভে রেকর্ড সম্ভব হলো?

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সৌদি আরবের রিয়াদে থাকেন বাংলাদেশের চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইকবাল হোসেন।  লকডাউন ও করোনার জের ধরে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করে গত ১৭ জুন গ্রামের বাড়িতে বাবার কাছে টাকা পাঠিয়েছেন তিনি এবং এবার একটু বেশি পরিমাণেই পাঠানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।  তিনি জানান, ‘এই দু:সময়েও টাকা পাঠিয়েছি যাতে বাবা-মা ও আমার পরিবার কোনো সমস্যায় না পড়ে।  দেশের এই অবস্থায় তারা যেন সুন্দরভাবে চলতে পারে।  বেশি করে টাকা পাঠিয়ে এমনকি আমি বাবাকে বলেছি যে আশেপাশের লোকজন যারা সংকটে পড়েছে তাদেরকেও যেন কিছুটা সহায়তা করেন’।
আবার সৌদি আরবেই গৃহপরিচারিকার কাজ করেন লাভলী খাতুন।  মার্চ ও এপ্রিল মাসে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাননি।  কিন্তু জুনের প্রথম সপ্তাহে তিনি বাড়িতে থাকা তার মা ও মায়ের কাছে থাকা দুই সন্তানের জন্য বেশি করে টাকা পাঠিয়েছেন।  তিনি জানান, ‘আগে দু’মাস পাঠাইনি।  আবার সামনে ঈদ আসতেছে।  তাই ভাবলাম এই সুযোগে একটু বেশি করে পাঠাই।  নিজের জমানো কিছু ছিলো আর রিয়াদের কাছেই আমার এক আত্মীয়ও থাকে, ওনার কাছ থেকে ৫০০ রিয়াল ধার করে সব এক সাথে বাড়ি পাঠাইছি’।
ঢাকার দোহারের এক গ্রামে থাকা লাভলী বেগমের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, মেয়ের কাছ থেকে টাকা না পেয়ে এপ্রিলে তাকে টাকা ধার করতে হয়েছিল।  এখন অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে আগে দেনা শোধ করেছেন।  বাড়তি টাকাটা মেয়ে না পাঠালে তো বিপদে পড়ে যেতাম।
এভাবেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের পাঠানো টাকা অর্থাৎ রেমিটেন্সে তৈরি হয়েছে একটা নতুন রেকর্ড, যার ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে গত ২ জুলাই (বৃহস্পতিবার)।
গত বছরের শেষার্ধে চীনের উহানে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের যে ধারা শুরু হয়েছিলো তার ঢেউ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আসার পরপরই রেমিটেন্স নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন কম বেশি সবাই।  এর মধ্যেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লকডাউনের কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের চাকুরি হারানো বা কাজ না পাওয়ার খবরে আশংকা ছিল রেমিটেন্স নিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ বা ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।  এটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেশি।  ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন রেমিটেন্স এসেছিল।  এবার ৩০ জুন দিন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।  এর মধ্যে শুধু জুনেই এসেছে ১৮৩ কোটি ডলারের বেশি রেমিটেন্স, যা মাসের হিসেবে সর্বোচ্চ।
আর মহামারির মধ্যেও এমন খবরে খুশি সরকারি মহলও, যার প্রমাণ হলো অর্থ বছরের শেষ দিনে ২ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাতেই অর্থমন্ত্রীর একটি বার্তা, যা গণমাধ্যমে পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়।  এতে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি তার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
যদিও এর আগে মার্চের দিকে রেমিটেন্স প্রবাহ কমতে থাকায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে রেমিটেন্সের জন্য ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল সরকার। খবর বিবিসি বাংলার
জুনে রেকর্ড রেমিটেন্সের কারণ কি?
মধ্যপ্রাচ্যে লকডাউনের পর প্রবাসীরা যে বিপাকে পড়েছিলেন তার রেশ পড়তে শুরু করে মার্চের দিকে।  কিন্তু জুন নাগাদ এসে পরিস্থিতি পাল্টে রেমিটেন্সের নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়ার কারণগুলো নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।  রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর মেহেদী হাসান বলেন, এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বগতি হয়েছে, যা অনেকে চিন্তাই করতে পারেনি।  এটি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক।  তবে এর কারণগুলো বলা খুব কঠিন।  কারণ সময়টা আসলেই ভালো নয়।  আমরা আগামি দুই-তিন মাস পর্যবেক্ষণ করবো।  তারপরেও হয়তো রেমিটেন্সের গতি প্রকৃতি ও কারণগুলো সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হবে।
তারপরও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রেমিটেন্স বাড়ার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন মেহেদী হাসান। এগুলো হলো- এক-  লকডাউন চলার কারণে অনেক দিন কাজ ছিল না।  এখন লকডাউন উঠে গেছে।  লকডাউনের কারণে যারা মাঝের সময়ে টাকা পাঠাতে পারেননি তারা গত মাসে সেটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন হয়তো বাড়িতে বাড়তি টাকা পাঠিয়ে।  দুই- লকডাউনের সময় অনেকেরই কোনো কাজ ছিল না, ফলে আয়ও ছিল না।  নিজের জমানো যা ছিল তা খরচ করতে হয়েছে নিজের জন্য।  ফলে হয়তো বাড়িতে পাঠাতে পারেনি।  এখন লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অনেকেই নতুন করে কাজ শুরু করেছেন।  তারাও রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন যতটা সম্ভব বেশি করেই।  তিন- করোনা পরিস্থিতির জের ধরে অনেক কোম্পানি শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।  এজন্য যাদের ছুটি দেয়া হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অতিরিক্ত অর্থও দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।  গত মাসের রেমিটেন্সে তারও একটি অবদান থাকতে পারে।  চার- আবার করোনা অবস্থার কারণে সার্বিকভাবে কাজের সুযোগ কমে গেছে।  অনেক দিন ধরে আছেন ও ভালো টাকা পয়সা জমিয়েছেন, এমন অনেকে হয়তো চিন্তা করতে পারেন যে সৌদিতে যেহেতু কাজের সুযোগ এখন কম, তাই বরং সব টাকা নিয়ে দেশে গিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করি।  সে কারণেও অনেকে বাড়তি টাকা পাঠানো শুরু করেছেন যা রেমিটেন্স প্রবাহ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
রিয়াদে থাকা বাংলাদেশি সাংবাদিক সাগর চৌধুরী বলেন, তিনি এ নিয়ে প্রবাসীদের অনেকের সাথেই কথা বলেছেন।  তাতে তার ধারণা হয়েছে- প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষ করে শ্রমিকরা জানে বাংলাদেশের গ্রামীণ বাস্তবতায় পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে থাকলেও অন্যরা সেই পরিবারকে ধনী ভাবতে শুরু করে।  তিনি কলেন, ‘শ্রমিকরা জানে তাদের পরিবারকে দেশে কেউ সহায়তা করবে না, বিদেশে পরিবারের সদস্য আছে এই যুক্তি দিয়ে।  সে কারণেই লকডাউন ও কারফিউতে বিপর্যস্ত হয়েও তারা জুনে এসে বাড়তি টাকা পাঠানোর চেষ্টা করেছেন দেশে থাকা পরিবারকে’।
প্রতিকূল বছরেও রেমিটেন্স ও রিজার্ভে উল্লম্ফন : আর কোনো কারণ আছে?
অর্থনীতির গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশে মানুষের আয় উপার্জন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় গত মাসে প্রবাসীরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকে বা অনেকে ধার দেনা করেও পরিবারের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন, তারই প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্সে।  আবার অনেকে হয়তো দেশে শিফট করবেন- সেজন্য ধীরে ধীরে জমানো টাকা দেশে আনার কাজ শুরু করেছেন বলেও রেমিটেন্স বেশি এসেছে বলে মনে হচ্ছে।  এর বাইরে গত বছর সরকার যে দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তারও ইতিবাচক প্রভাব রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রে রেমিটেন্সের পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও এআইআইবির ঋণ সহায়তারও ভূমিকা ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ কমে আসার কিছু ভূমিকা আছে বলেও মন্তব্য করেন ড. জায়েদ বখত।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ