১৫ জনের সিন্ডিকেট, ফোন করলেই বাড়ে পেঁয়াজের দাম!

ফাইল ছবি।

রোকসানা রুনা, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
‌‘বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে আমরা পেঁয়াজের দাম বাড়াই।  কোনো কোনো সময় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।  পেঁয়াজগুলো বন্দর থেকে এখানে আসার আগেই আমাদের ফোন করে একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেন।  আর আমরা চাইলে সেখানে আরো কিছু অতিরিক্ত দাম যোগ করে দেই’।  এমনভাবেই পেঁয়াজ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের এক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যবসায়ী বলেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আসে বাংলাদেশে।  এর সিংহভাগ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে।  আমদানিকারকরা একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দিয়ে সে পেঁয়াজ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পাঠান।  কিন্তু বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ১৫ জনের একটি চক্র প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন ৩০ টাকা পর্যন্ত।  এছাড়া যারা পেঁয়াজ মজুদ করেন তারা দাম বাড়িয়ে দেন আরো এক বা দুই গুণ।  এভাবেই ২০ টাকার পেঁয়াজ বেড়ে হয় ৫০ টাকা।
এক সপ্তাহ আগেও চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ মান ভেদে ২৫ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।  কিন্তু সেই পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় যা খুচরা পর্যায়ে ৭৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজিতে জড়িত আমদানিকারকদের চিহ্নিত করা গেলে ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের নামও বেরিয়ে আসবে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রধানত হিলি স্থলবন্দর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আসে।  গত বছরের শেষের দিকে আমদানি করা প্রতি কেজি ৪২ টাকা দরে কেনা পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জের আড়তে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রির প্রমাণ পায় জেলা প্রশাসন।  এতে খাতুনগঞ্জ ও কক্সবাজারের ১৫ জনের একটি সিন্ডিকেট জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।  এবারও দাম বাড়ার পেছনে তাদের কারো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
শুধু ফোনে দাম নির্ধারণ করে খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের বাজার অস্থির করার পেছনে আমদানিকারকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসন।  হিলি স্থলবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে আমদানিকারকদের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হিলি স্থলবন্দরে পেঁয়াজ আমদানিতে তৈরি সিন্ডিকেটে জড়িত আছেন ১৫ জন।  তারা হলেন মেসার্স রায়হান ট্রেডার্সের মো. শহিদুল ইসলাম, মেসার্স এমআর ট্রেডার্সের মো. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, মেসার্স সততা বাণিজ্যালয়ের মো. বাবলুর রহমান, মেসার্স সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজের মো. সাইফুল ইসলাম, মেসার্স জগদীশ চন্দ্র রায়ের শ্রীপদ, মেসার্স মারিয়া কর্পোরেশনের মো. মোবারক হোসেন, মেসার্স টুম্পা ইন্টারন্যাশনালের মো. মামুনুর রশিদ লেবু, মেসার্স গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের মো. লাবু মল্লিক, মেসার্স সালেহা ট্রেডার্সের মো. সেলিম রেজা, মেসার্স ধ্রুব ফারিহা ট্রেডার্সের মো. নাজমুল আলম চৌধুরী, মেসার্স সাদ ট্রেডার্সের মো. গোলাম মোর্শেদ শাহিন, মেসার্স বাবু এন্টারপ্রাইজের মো. মাহফুজার রহমান বাবু, মেসার্স লাবীব ট্রেডার্সের মো. নূর আলম বাবু, মেসার্স মনির ট্রেডার্সের মো. তোজাম্মেল হোসেন এবং মেসার্স তুবা এন্টারপ্রাইজের মো. শাহজামাল হোসেন।  এসব আমদানিকারকের মধ্যে কারা ফোনে ফোনে খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বাড়ান এবং কারসাজিতে কারা জড়িত তা চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলো।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করা হবে।  তিনি বলেন, পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও বাড়তি লাভের আশায় হঠাৎ আমদানিকারকের এক ফোনেই কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছি আমরা।  লেনদেনের কাগজপত্র নিজেদের কাছে না রেখে আমদানিকারকের ফোন কলে দাম নির্ধারণ করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন খাতুনগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ী ও আড়তদার।  হিলি স্থলবন্দরের ১৫ আমদানিকারকের মধ্যে কারা খাতুনগঞ্জে কারসাজি করছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথেই আগের মজুদ রাখা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সব পর্যায়ের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা।  গতকাল রাত পর্যন্ত যে পেঁয়াজ ৩০-৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে তা রাত পোহাতেই বেড়ে হয়েছে ৭৫-৯০ টাকা।  এই মূল্য আজ থেকে আরো বাড়তে পারে যা কেজিপ্রতি ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর তথ্য বাজারগুলোতে উড়ে বেড়াচ্ছে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা বিশেষ করে খুচরো ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনতে রীতিমতো যুদ্ধ করছেন।  এখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে সাধারণের পকেট থেকে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে একাধিক সিন্ডিকেট পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করবে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।  মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনেকটা প্রতি সেকেন্ডে দাম বেড়েছে পেঁয়াজের- এমন তথ্যও জানা গেছে।

ডিসি/এসআইকে/আরআর