খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক : টিআইবি

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>
ব্যবসায়িক চাপে সরকারের ‘জিম্মি’ অবস্থা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে ঋণখেলাপিরা জনগণের অর্থ লুটপাটের সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।  মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যার উপর জনগণের এই আমানত তদারকিসহ সুরক্ষার দায়িত্ব, তারা জনগণের অর্থ লুটপাটকারী এবং তাদের হাতে জিম্মি যে সরকার এই দুই শক্তির চাপের ফলে এটি প্রায় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।  বিশেষ করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে’।
টিআইবির করা ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।  টিআইবির এই গবেষণায় গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান ধারার বিশ্লেষণের পাশাপাশি সেটির তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামো এবং নেতৃত্বের দুর্বলতার নানা দিক তুলে ধরা হয়।
সেখানে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও পরবর্তীতে খেলাপি ঋণের হার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।  অর্থাৎ দশ বছরে বৃদ্ধি ৪১৭ শতাংশ।  যদিও একই সময়ে মোট ঋণ বৃদ্ধির হার ৩১২ শতাংশ; প্রতি বছরে গড়ে বৃদ্ধি ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বরাতে টিআইবি বলছে, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ (৫৪,৪৬৩ কোটি টাকা) যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছেকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে বার বার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়ার কথাও গবেষণায় তুলে ধরেছে টিআইবি।
সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়।  এভাবে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই সেপ্টেম্বর ২০১৯ হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।  জুন ২০২০-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬,১১৭ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের কার্যক্রম যেমন ফিন্যান্সিয়াল রেগুলেশন প্রণয়ন, অফসাইট তদারকি, খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার অনসাইট তদারকি, সমন্বিত তদারকি নামমাত্র রয়েছে কাগজেকলমে।  তদারকি কার্যক্রমে বাহ্যিক প্রভাব ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের ভূমিকা বেশ প্রকট।  একদিক থেকে ঋণ খেলাপিগণ, অন্যদিক থেকে ঋণ খেলাপি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টিকারীরা এবং তার সুহৃদ উপরের মহল, অন্যদিক থেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলের নিয়ন্ত্রণ এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে।
ব্যাংকে একক পরিবারের নিয়ন্ত্রণ
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে কিছু পরিবারের হাতে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগ করে গবেষণায় বলা হয়, একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান, পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুইবারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিনবারে সর্বোচ্চ নয় বছর থাকার বিধান এবং এছাড়া একই পরিবারের চারজন সদস্যের বাইরে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের ২% ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, ‘নিয়মিত ঋণ গ্রহীতার চেয়ে ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের জন্য সহজ শর্ত দেওয়া হয়েছে।  এর মাধ্যমে নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকে খেলাপি হতে উৎসাহী করা হল।
মন্দমানের খেলাপি ঋণের সময়কাল পাঁচ বছরের স্থলে তিন বছরে অবলোপনের সুযোগ এবং শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান শিথিল করার কথা উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, ‘খেলাপি ঋণ কাগজে কলমে কম দেখানো, খেলাপি ঋণকে উৎসাহিত করা এবং অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে ব্যাংকের তৎপরতা হ্রাস করা হয়েছে।  ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মানদন্ড অনুসরণ না করে শ্রেণিকৃত ঋণের প্রতিধাপে তিনমাস করে সময় বৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করা হয় গবেষণায়।  ‘প্রয়োজন না থাকা স্বত্বেও’ শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবিত বা বাধ্য করা হয়েছে বলে মনে করছে টিআেইবি।  নতুন ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তার মধ্যে মন্ত্রী, সাংসদ, ও তাদের পরিবারের সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, ছাত্র সংগঠনের নেতা, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ উল্লেখযোগ্য’।
নতুন ব্যাংকের ইক্যুইটি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকৃত অর্থ আয়কর রিটার্নে ঘোষিত সম্পদ থেকে পরিশোধের বিধান থাকলেও অনেকগুলো ব্যাংকে ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।
টিআইবি বলছে, একক বা যৌথভাবে কোনো ব্যাংকের দশ শতাংশের বেশি শেয়ার ক্রয় না করার বিধান থাকলেও এর ব্যাত্যয় ঘটছে।  বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় বা রাজনৈতিক প্রভাবে বাধ্য করে নামে-বেনামে কতিপয় ব্যবসায়ী কর্তৃক অধিক শেয়ার ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে।  একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ কর্তৃক ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংকের ২৮ শতাংশ এবং সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে অপর একটি ব্যাংকের ১৪ শতাংশ শেয়ার ক্রয়’।
একক পরিবারের পরিচালক সীমা লঙ্ঘন করে একাধিক ব্যাংকে একই পরিবারের চারের অধিক পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, ‘একটি ব্যাংকে স্বামী, স্ত্রী, দুই পুত্র, মেয়ে ও নাতিসহ একই পরিবারের ছয় জন পরিচালক রাখা হয়েছে।  বিশ্বব্যাপী ব্যাংক পরিচালক হিসেবে ব্যাংকের উদ্যোক্তা বা শেয়ারধারক নন এমন বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগের চর্চা থাকলেও বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়।  ব্যাংক পরিচালনায় পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আত্মীয় বা স্বজনদের মধ্যে থেকে অযোগ্য ও অদক্ষ পরিচালক নিয়োগ করা হয়।  পরিচালক হতে ব্যাংক অথবা অন্য ব্যবস্থাপনা কিংবা পেশাগতভাবে দশ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক ব্যাংকে ব্যক্তি সম্পর্কের ভিত্তিতে অনভিজ্ঞ পরিচালক নিয়োগ করা হয়ে থাকে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।  এছাড়া আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক ঋণ খেলাপি পরিচালক বিদ্যমান থাকার নজিরও লক্ষ করা যায়’।
নিজেদের মধ্যে ঋণ-সুবিধা
ব্যাংকের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর কতিপয় ব্যবসায়ী-শিল্পগ্রুপ, তাদের নিযুক্ত পরিচালক ও উচ্চ পদস্থ ব্যাংকার, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করার কথাও উল্লেখ করেছে টিআইবি।
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত দেশের ৫৫টি ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নেওয়ার কথা তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়, ‘যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ।  এছাড়া এসকল ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে বেনামেও প্রচুর ঋণ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
এসকল ঋণের বিপুল পরিমাণ অংশ পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যায় এবং প্রভাবের মাধ্যমে এই খেলাপি ঋণে বারবার সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও অবলোপন ইত্যাদি বাড়তি সুবিধা নেওয়া হয়ে থাকে বলেও মনে করছে টিআইবি।
যোগসাজশ বা সিন্ডিকেশনের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর অধিক খেলাপি ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, ‘৫০ শতাংশের অধিক খেলাপি ঋণের বোঝা এই ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর রয়েছে।  যোগসাজশ থাকার কারণে ঋণ খেলাপি পরিচালকের বিরুদ্ধে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক হতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নোটিশ প্রদান না করায় ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না।  অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা আদালত হতে উক্ত বিষয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা হয়।  এবং অনেক ক্ষেত্রে যোগসাজশে বৃহৎ খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মামলা কার্যক্রম দুর্বল করার মাধ্যমে ঋণ খেলাপির অনুকূলে রায় হয়’।
এক্ষেত্রে টিআইবি উদাহরণ টেনেছে- একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।  যা একাধিকবার পুনর্গঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আবার খেলাপি হলেও তিনি কখনও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হন না।
এ সব দিক উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত পরিচালনায় আইনি দুর্বলতা পাওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে প্রভাবশালী মহলের চাপে সেগুলো আরও দুর্বল করে দেওয়ার প্রবণতা গবেষণায় পাওয়া গেছে।  রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহের ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি সে ভূমিকাটা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ বললে কোনো অত্যুক্তি হবে না’।
স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যতটুকু আইনি কাঠামো আছে, তার মধ্যে থেকেও আমরা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর ভূমিকা দেখেছি।  যদি নেতৃত্বের গুণাবলি থাকত, সৎসাহস, দৃঢ়তা থাকত- তাহলে আমরা এতটা খাদের কিনারে এসে পৌঁছাতাম না’।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ