বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কৃষকেরা। ফলন ভালো হলেও তাদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কারণ, বাজারে আলুর দরপতন ঘটেছে। ধরণ ভেদে কোথাও আলুর কেজি ১০ টাকা, আবার কোথাও ১৫ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
আলুর দাম নিয়ে শঙ্কায় কৃষক। বাজারে নতুন আলুর দাম নিম্নমুখী হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছরও শুরুতে আলুর দাম বেশি থাকায় অধিক লাভের আশায় কৃষকেরা ব্যাপকভাবে আলু চাষে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু এবছরের শুরুতেই আগাম জাতের নতুন আলুর দাম কম হওয়ায় ভরা মৌসুমে আলুর বাজার নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বাজার দর নিম্নমুখী হওয়ায় অনেক কৃষক আলু পরিচর্যায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সুষ্ঠু পরিচর্যা আর অনুকূল পরিবেশের কারণে চন্দনাইশের শঙ্খ নদীর দু’পাড়সহ এ অঞ্চলে সর্বত্রই আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন হয়।
আলু চন্দনাইশ অঞ্চলে রবি মৌসুমের অর্থকরি ফসল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে শীতকালীন ফসল হিসেবে আলু চাষ করে আসছেন কৃষকেরা। অনেকেই ইতোমধ্যে আলু তুলে বাজারে বিক্রি শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু দাম কমে যাওয়ায় কৃষকেরা আর্থিক ক্ষতি নিয়ে চিন্তিত। মৌসুমের শুরুতে আলুর দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ টাকায় নেমে এসেছে। ভরা মৌসুমেও আলুর দাম নিয়ে তাই চরম শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকেরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে, কৃষকেরাও আলু চাষে মনোযোগি হয়েছেন। তবে সঠিক দাম না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন আলু চাষিরা।
দোহাজারী রেলওয়ে মাঠের সবজি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আলু নিয়ে চাষিরা ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও ক্রেতা পাচ্ছেন না তেমন। আলু বিক্রেতা সৈয়দ হোসেন জানান, চন্দনাইশের তিনটি হিমাগার রয়েছে। গত বছর আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় অনেকের আলু হিমাগারে রয়েছে। সেখান থেকে এখনও আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজার এখনো পুরনো আলুর দখলে। চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেড়ে গেছে। সে কারণে দাম কমেছে। সন্তেুাষজনক দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক ক্ষেত থেকে আলু তুলছেন না।
কৃষক রিপন হাওলাদার বলেন, স্বপ্নের ফসল বিক্রি করতে গিয়ে কষ্টে বুক ভারী হয়ে উঠেছে। উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামও তিনি পাননি। প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন মাত্র ১০ থেকে ১২ টাকায়। ‘চিন্তায় দু’চোখে ঘুম আসে না। কিভাবে এনজিও’র ঋণের কিস্তি শোধ করবেন সে চিন্তায়। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করেছেন। চার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, মাকে নিয়ে ৭ জনের সংসার কিভাবে চলবে। তবুও দুঃখ ভুলে আবার ফসল বুনবেন। চাষবাস ছাড়া তার আর কিছু শিখেননি। বারবার কাঁদালেও কৃষি নিয়েই মাটি কামড়ে আছি- বলেন তিনি।
তিনি জানান, আমার তিন বিঘা জমিতে ফলন হয়েছে ২১০ মণ। িপ্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ করে আমি পেয়েছি ৫১ হাজার টাকা।
কৃষকেরা জানান, এক বিঘা জমিতে আগাম আলু উৎপাদন করতে সাধারণত ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়। গড়ে এক বিঘা জমিতে ৭৫ মণ আলু উৎপাদন হয়। সে হিসাবে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকার বেশি। অথচ এ শীত মৌসুমে অন্যান্য সবজির দাম বাড়তি থাকলেও আলুর ক্ষেত্রে অন্যরকম। লাভ-লোকসানের এই চক্রের সঙ্গে তারা আর পেরে উঠছেন না। অনেকেই লাভের আশায় চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। সংরক্ষিত আলু বাজারজাত না করতে পারলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রিত থেকে যাবে। ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরা আগামিতে আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। আলুর বাজারমূল্যে এ বিপর্যয় ঠেকাতে প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ প্রয়োজন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাত্র ৫৬ হাজার টন আলু মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, বরুলাই, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বছর বছর রপ্তানি কমে যাওয়ায় আলুর দরপতন ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি উপযোগী ১৮টি আলুর উন্নতজাতের নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার বলেন, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় শীতকালীন সবজি আলুর ফলন ভাল হয়েছে। চন্দনাইশের উৎপাদিত আলু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করে থাকে। তাছাড়া চন্দনাইশে বড় ধরণের তিনটি হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ রয়েছে। তাই কৃষকেরা দাম না পেলে হিমাগারে আলু রাখবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ডিসি/এসআইকে/সিসি