দুই দিনে ৩২ কেজি ১৩২ গ্রাম ওজনের তিনটি মৃত মাছ উদ্ধার হালদায়

উত্তর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
বিশ্বের অন্যতম জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদী শুধুই একটি নদী নয়; এটি রূপালি সম্পদের খনিও বটে।  তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারাদেশে যখন উৎসবমূখর পরিবেশে মৎস্য পক্ষ ২০২২ উদ্যাপিত হচ্ছে- ঠিক এমন সময়ে অভাগা এই হালদার ওপর নদী পাড়ের কিছু অতিলোভী অসাধু দুর্বৃত্ত ও মৎস্যদস্যু অবলীলায় হামলে পড়ছে।  ফলে প্রতিদিন হালদা নদীতে মরে ভেসে উঠছে মা-মাছ আর ডলফিন।  এই নদীর এমন করুণ অবস্থা আর আহাজারী নিয়ে বেশ কিছু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের টনক নড়ছে না; কেউ শুনছে না বিপর্যস্ত হালদা নদীর মরা কান্না।  মৎস্য দফতরের সংশ্লিষ্টদের হেঁয়ালিপনার ফলে হুমকির মুখে পতিত বিপর্যস্ত হালদার অস্তিত্ব, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য-এমনটাই মনে করছেন হালদা গবেষক এবং এ নদী পাড়ের মানুষ।
হালদা নদীর এই কান্নার মধ্যেই মাত্র ৩৬ ঘন্টার ব্যবধানে প্রায় ৩২ কেজি ৭৭২ গ্রাম ওজনের তিনটি ডিমওয়ালা কাতল মাছ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা।  তবে, সেগুলো জীবিত নয়, মরে পঁচে ভেসে উঠেছে এই মাছগুলো।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) সকালে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুূয়ারা নয়াহাট থেকে ১২ কেজি ২৬০ গ্রাম ওজনের কাতল ব্রুড মাছ (মা মাছ) মরা অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয়রা।  মাছটির দৈর্ঘ্য ৩ ফুট ২ ইঞ্চি এবং উচ্চতা এটি ১ ফুট বলে জানা গেছে।  এদিন বিকেলের দিকে প্রায় ১০ কেজি ৭৭২ গ্রাম ওজনের আরো একটি মরে পঁচে যাওয়া ডিমওয়ালা কাতল মাছ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।  হালদা পাড়ের সত্তার হাটের পুরান বাজারের কাছ থেকে উদ্ধার করা এই মাছটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ ফুট বলে জানা গেছে।
তার আগের দিন ২৫ জুলাই সকালে হালদা নদীর কাগতিয়া স্লুইচ গেটের অপর পাশে প্রায় ৯ কেজি ১০০ গ্রাম ওজনের আরো একটি কাতলা ডিমওয়ালা ব্রুড মাছ মরা-পঁচা অবস্থায় উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।  এটির দৈর্ঘ্যও প্রায় ২ ফুট ১০ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১০ ইঞ্চি।  মাছগুলো পঁচে যাওয়ায় হালদা পাড়েই মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১ জুন সকালে হালদা নদীর আজিমের ঘাট এলাকা থেকে ১২ কেজি ওজনের অপর একটি মৃত কাতল ব্রুড মাছ (দৈর্ঘ্য সাড়ে ৩ ফুট ও প্রস্থ আড়াই ফুট) মরা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।  পরে ৬ বছরের কিছু বেশি বয়সী মৃত কাতল মাছটি উদ্ধারের পর হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।  উদ্ধারকৃত এসব মাছের শীরের কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।  তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মাছ শিকারের জন্য হালদা নদীতে মৎস্যদস্যুদের দেয়া বিষক্রিয়ায় এসব মাছের মৃত্যু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মৎস্য, কৃষি ও পানি সম্পদের প্রাচুর্যে হালদা নদীর অর্থনৈতিক অবদান জাতীয় পর্যায়ে ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।  পঞ্চাশের দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত হালদা।  এছাড়া, হালদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় উঠে এসেছে, হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি কার্প (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস) মাছ থেকে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।  অথচ হালদা নদীতে গত দুই দিনে দুইটি এবং চলতি বছরে ১ মাস ২৬ দিনের মধ্যে ৩টি কাতলা ব্রুড মা-মাছ মরে ভেসে উঠেছে, যা হালদা নদীর ইতিহাসে নতুন নয়।  তবে তা খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হালদায় এ পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে বিচরণ করা ৩৮টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে।  এরমধ্যে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে হালদা নদীতে ১৮টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়।  ২০১৮ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়।  ২০২১ সালে মোট ৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়।  চলতি বছরে ৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।  যা নিয়ে বেশ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ২১ জুলাই সকালে হালদার আজিমের ঘাট এলাকা থেকে প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৬০ কেজি ওজনের ৩৮তম, ২০ জুলাই দুপুরের দিকে একই এলাকা থেকে ৩৭তম এবং গত ১৪ জুলাই হালদার সংযোগ খাল বুড়িসর্তায় ৩৬তম মৃত ডলফিনটি উদ্ধার করে।  এরমধ্যে ৩৭তম মৃত ডলফিনটির ঠোঁটের নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন করে ঠোঁটের দাঁতগুলোও ফেলে দেয়া হয়েছে।  এতে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেছিলের- ওই ডলফিনটি মৎস্যদস্যুদের জাল আটকে মারা গিয়েছিল।  এরপর মৎস্যদস্যুরা ডলফিনটির ঠোঁটের নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে ঠোঁটের দাঁতগুলোও উপড়ে ফেলেছে।  তবে, ডলফিনটি চবি পরীক্ষাগারে নেয়ার সুযোগ হয়নি।  ধারণামতে, ৩৬তম মৃত ডলফিনটি ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আকারের।  কিন্তু বন বিভাগের হেঁয়ালিপনার কারণে মৃত ডলফিনটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
নদী পাড়ের বাসিন্দা ও ডিম সংগ্রহকারীদের অভিযোগ, এক সময় হালদা নদীতে বালু উত্তোলন কাজে নিয়োজিত ইঞ্জিনচালিত যান্ত্রিক যানের ঘূর্ণায়মান পাখার আঘাতে মা-মাছসহ জলজ প্রাণি সবচেয়ে বেশি মারা যেতো।  সম্প্রতি বালু উত্তেলন বন্ধ না হলেও যান্ত্রিক যানের অত্যাচার কিছুটা কমলেও বেড়েছে মৎস্যদস্যুদের তৎপরতা।  তারা আইনের তোয়াক্কা না করে দিবারাত্রি নদীতে ঘেরা, ভাসা ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা-মাছ শিকার করে আসছে।  এরমধ্যে প্রশাসন তৎপর হলে তারা (মৎস্যদস্যু) নদীতে বিষ প্রয়োগে মা-মাছ শিকার করছে।  তাছাড়া এসব মৎস্যদস্যুদের জালে আটকা পড়ে প্রতিনিয়তই মৃত্যুবরণ করছে পরিবেশ নিদের্শক অতিবিপন্ন জলজ প্রাণি ডলফিন।
এভাবে দিনের পর দিন মিঠা পানির মা-মাছ ও পরিবেশ নিদের্শক অতিবিপন্ন জলজ প্রাণি ডলফিনের মৃত্যু অব্যাহত থাকলে হালদা মা-মাছ এবং ডলফিন শূন্য হয়ে যাবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা রিচার্স ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর হালদা গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া।
তিনি বলেন, হালদা নদীর মা-মাছ ও জীববৈচিত্র্যের মৃত্যুর বিষয়টি বেশ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার।  সারাদেশে যখন উৎসবমুখর পরিবেশে মৎস্য পক্ষ-২০২২ উদ্যাপিত হচ্ছে, দেশের সর্বত্র দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে হালদা নদীতে পরপর দুইদিন ৩টি ব্রুড মাছের মৃত্যু খুবই অপ্রত্যাশিত।  দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবেও অপূরণীয় ক্ষতি।  তাই হালদা নদীর পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
এদিকে, সম্প্রতি সময়ে হালদা নদীতে সবচেয়ে বেশি অভিযান পরিচালনা করেছে নৌ-পুলিশ।  দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হাটহাজারী এবং রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)।  তবে এক্ষেত্রে হাটহাজারী ও রাউজান মৎস্য অফিসের তেমন কোনো উল্লখযোগ্য অভিযান চোখে পড়ার মতো ছিল না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকতা ফারহানা লাভলী জানান, কে বলেছে আমরা অভিযান পরিচালনা করিনি।  প্রতিদিন ইউএনও অভিযান পরিচালনা করছেন।  এ সময় মুঠোফোনে শুধুমাত্র গত ছয় মাসে হাটহাজারী ও রাউজান দুই মৎস্য অফিস কয়টি অভিযান পরিচালনা করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হালদা কি শুধু একা মৎস্য বিভাগের নাকি!  অভিযানের দায়িত্ব সরাসরি আমাদের না।

ডিসি/এসআইকে/এসইউআর