অর্থনীতি সংকটে নেই, চাপে আছে : দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশের অর্থনীতি সংকটে নেই, তবে চাপে আছে।  তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখন যে অস্থিরতা চলছে, তা সহসাই কাটবে না।  ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকবে।  যারা বলছেন, শিগগির সংকট কেটে যাবে, তারা চটজলদি রাজনৈতিক চিন্তা থেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন।  এতে বাজারে অস্থিতিশীলতা ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ইআরএফ সংলাপ’ অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী।  ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
দেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না হওয়া, কর আহরণের দুর্বলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য অর্থনীতির প্রধান বিচ্যুতি।  এসব বিচ্যুতি ঠিকভাবে মোকাবিলা করা না গেলে পরে উত্তরণ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।  একই সঙ্গে যে অর্জন হয়েছে, সেটিও টেকসই হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্জনও আছে।  বিচ্যুতিও আছে।  এই বিচ্যুতি অর্জনকে দুর্বল করে দিতে পারে।  টেকসইতা কমিয়ে দিতে পারে।  তবে বাংলাদেশ অনেক সমস্যা উত্তরণ করে এ অবস্থায় এসেছে।  আশা করা যায়, আগামিতে সমস্যা উত্তরণ করে এগিয়ে যাবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে জটিল ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।  দেশে ও বিশ্বে এমন পরিস্থিতি হতে পারে, তা আগেই বলা হয়েছিল।  পাশাপাশি এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি স্থিতিকরণ কর্মসূচি জরুরি বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল।  যে কারণে জিডিপির অভিলাষ সংযত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ও বৈদেশিক লেনদেন নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।  বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত শেষ হবে না।
সিপিডির এই ফেলো বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা বৈদেশিক লেনদেনে নয়।  মূল সমস্যা আর্থিক খাতের দুর্বলতা।  প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়া।  যে কারণে জ্বালানিতে ভর্তুকি, দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।  তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দ্বারা ধাবিত।  বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি।  জিডিপির ২৩ বা ২৪ শতাংশে আটকে আছে।  রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ৫ বা ৬ শতাংশ থেকে ৭ বা ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।  সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও হয়নি।  এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে, যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট না।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি হলে সেগুলোর সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ে।  কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি।  বাংলাদেশের অবস্থা এক ইঞ্জিনে চলা অ্যারোপ্লেনের মতো, যা বেশি দূর যেতে পারে না।  কিছু দূর চলার পর রানওয়ে খুঁজতে থাকে’।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে।  এর অর্থ আয় বাড়ছে।  তাহলে কর সংগ্রহ হচ্ছে না কেন?  তাহলে কি কর সংগ্রহ করা হচ্ছে না?  নাকি হিসাবের গড়মিল আছে?  কর সংগ্রহ করতে না পারার কারণে এখন আমদানি করা যাচ্ছে না।  খাদ্য সহায়তা বাড়ানো যাচ্ছে না।  শুল্ক কমাতে পারছে না।  পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হচ্ছে বেশি।  যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেই বরাদ্দ থাকছে না।  ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।  অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকছে জিডিপির এক শতাংশ।  শিক্ষাতেও সমপরিমাণ।
‘রাজনৈতিক শক্তি বৈধতার জন্য খুব দ্রুততার সঙ্গে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে চাচ্ছে।  রাজনৈতিক ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে।  কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের ফল আসতে দশকের বেশি সময় লাগে।  রাজনৈতিক চক্রে এ সময় নেই।  পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য হচ্ছে।  করোনার সময় সহায়তা বিতরণে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দিয়েছে, যার যা প্রাপ্য তা নথিভুক্ত হয়নি।  ফলে প্রমাণিত হয়েছে সরকারের সেবা পাওয়ায় দুর্বল নাগরিকদের জন্য সহজ নয়’ বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।  বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।  এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না।  এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে সরকার, মানুষ ও দেশের।  বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে।  বিচারের সুযোগও তুলে নেওয়া হয়েছে।
সিপিডির ফেলো আরও বলেন, পুঁজিবাদের বিকাশে সব দেশেই লুণ্ঠন হয়।  বাংলাদেশে প্রথমে আর্থিক খাতে লুণ্ঠন হয়েছে।  পরে হয়েছে পুঁজিবাজারে।  এখন সরকারি প্রণোদনায় অতিমূল্যায়িত প্রল্পের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন করছে।  তবে লুন্ঠনের পরে বিচার ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না।  এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সংযোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।  ফলে জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে।  এ পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তির’।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিনিময় হার বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার সঙ্গে অর্থপাচারের সংযোগ থাকতে পারে।  জ্বালানি তেলের দাম ৩৪ থেকে ৪৪ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে ৫ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত অনৈতিক অব্যবস্থাপনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।  তবে অনেক সংশয় ও শঙ্কার মধ্যে আশার বাণী শুনিয়েছেন সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয়।  তিনি বলেন, গত এক দশক দেশের ইতিহাসে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিশীল দশক।  বলতে হবে সফল দশক।  এসময়ে দেশ নিম্নআয় থেকে নিম্নমধ্যম আয়ে উন্নীত হয়েছে।  এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে এসেছে।  সফলভাবে এমডিজি অর্জন করেছে।  এসডিজি বাস্তবায়নে এগিয়েছে।  মানুষের আয়ুষ্কাল, কৃষি উৎপাদন, শিক্ষার হার, মাথাপিছু রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে।  বলতে হবে গত ১৩ বছর ছিলো অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমৃদ্ধ সময়।  তবে এ এতকিছুর পরও পেশাদার অর্থনীতিবিদদের দুঃখের কিছু বিষয় রয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ