ইন্দো-প্যাসিফিকে ঢাকা-টোকিও ঐকমত্য

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
কানেক্টিভিটি তথা যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন বিবেচনায় জাপানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী বাংলাদেশ। এজন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত স্তরে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের ইন্দো-প্যাসিফিক কাঠামোতে বাংলাদেশের আরও বেশি ভূমিকা রাখার বিষয়ে টেকিও’র প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে ঢাকা। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বৃহৎ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের আরও বড় আকারে সম্পৃক্ততার পথ প্রশস্ত হলো।
গত বুধবার টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পরে ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি জোরালোভাবে ফুটে উঠেছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী কিশিদার আমন্ত্রণে টোকিও সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ৮টি চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারক সই হয়েছে। ১০ পৃষ্ঠার ওই যৌথ বিবৃতিতে আঞ্চলিক এবং বৃহত্তর পরিসরে বৈশ্বিক ইন্দো-প্যাসিফিক কাঠামোর অধীনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। ৩০ পয়েন্টের ওই বিবৃতিতে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ স্থলে থাকা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, অবকাঠামোর উন্নতি হলে এ অঞ্চলে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পাবে- যা বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের উন্নয়নে সহায়ক হবে।
এছাড়া প্রতিরক্ষা এবং বেসরকারি খাতে বিদ্যমান সহযোগিতা বাড়াতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল আপগ্রেডেশন, কৃষি খাতে সহযোগিতা এবং সাইবার সিকিউরিটি ও আইসিটি উন্নয়ন বিষয়গুলো যৌথ বিবৃতিতে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে এবং এটি দুই প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানিয়েছেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ রয়েছে। যৌথ বিবৃতি মতে দুই প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রাকে আগামী ৫০ বছর এবং তারও পরে এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’- উন্নীত করতে সম্মত হয়েছেন। উভয় নেতা সহযোগিতা, বিশেষ করে এই অঞ্চলে এবং এর বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সহযোগিতা, পারস্পরিক সুবিধা ও আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে গভীরতর করার এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ সম্প্রসারণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন শীর্ষ বৈঠকের পর ঘোষিত জয়েন্ট স্টেটমেন্টে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির মধ্যে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- উত্তর কোরিয়া, অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক এবং মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) সমস্যা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বিবৃতিতে ইউক্রেনের জনগণের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।
ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে ঐকমত্য: জাপান সফরের একদিন আগে বাংলাদেশ নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করে। ওই আউটলুকের সঙ্গে জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অনেক মিল আছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। এরপর ২০২২ সালে ফ্রান্স সফর বিষয়ক যৌথ বিবৃতিতে এটি আরও খোলাসা করা হয়। জাপান সফরে ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে ইন্দো-প্যাসিফিক কাঠামোর অধীনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে দুই পক্ষের অভিন্ন অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য বিবৃতিতে দুই পক্ষ একমত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা ও জাহাজ বা উড়োজাহাজ চলাচলে সবার অধিকার আছে- এ বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
কৌশলগত সম্পর্ক
ভারত ও চীনের পর জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করলো বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে একটি বড় ঘটনা এবং এটির আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। এই কৌশলগত সম্পর্ক বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ অর্জনে সহায়ক হবে এবং জাপানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি চীন, ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হবে। গত বছর জাপান তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেকগুণ বাড়ায়। ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজির একটি উপাদান হচ্ছে- এ অঞ্চলের সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো। বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দায়িত্বশীল ব্যবহার ঢাকার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে জাপানের। এই স্মারকের উদ্দেশ্য হচ্ছে- দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সংলাপ জোরদার করা। এছাড়া দুই দেশের কর্মকর্তাদের সফর, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার আয়োজন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে অন্যান্য যেকোনো বিষয় নিয়ে সহযোগিতা। যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে এটা সিদ্ধান্ত হয়েছে- দুই দেশের দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উইং খোলা হবে। বৈঠকে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ এর মধ্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করার উদ্যোগের বিষয়ে জাপানকে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া প্রতিরক্ষা সামগ্রী ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়টিকে স্বাগত জানান তারা।
৩০ পয়েন্টের বিবৃতির অন্যান্য প্রসঙ্গ
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিও একমত হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী বাস্তুচ্যুতি আশ্রয়দাতা কমিউনিটির ওপর চাপ বাড়াবে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। উভয় নেতা এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য একটি ‘টেকসই, নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক ও মর্যাদাপূর্ণ’- প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। প্রধানমন্ত্রী কিশিদা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত ও স্কুলে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য জাপানে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সহিংসতা ও সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান। তারা মিয়ানমারের সংকট সমাধানের জন্য আসিয়ানের প্রচেষ্টার প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এ ব্যাপারে তারা আসিয়ান চেয়ারের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐক্যমত বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তারা এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমারের পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত নানাবিধ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসনের ভিত্তিতে বহুপাক্ষিকতার প্রতি তাদের সমর্থন নিশ্চিত করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রাথমিক সংস্কারসহ জাতিসংঘকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তাদের দৃঢ়সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী কিশিদা জাপানের স্থায়ী সদস্য হওয়াসহ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারে ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী কিশিদা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্যদের সবচেয়ে বড় অবদানকারী হিসেবে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকার পাশাপাশি ২০২২ সালের জন্য জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর সক্ষমতার প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ‘পিস বিল্ডিং সেন্টার’-এর সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানান। দুই প্রধানমন্ত্রী শান্তি সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে একমত হয়েছেন। উভয় নেতাই পারমাণবিক অস্ত্রহীন বিশ্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ