শেখ হাসিনা-মাখোঁ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, দুই চুক্তি স্বাক্ষর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসে পৌঁছান মাখোঁ। কার্যালয়ের টাইগার গেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।
বৈঠক ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে দুইটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে ঢাকা ও প্যারিস বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ক দুটি চুক্তি স্বাক্ষর ছিল।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের (পিএমও) করবি হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উপস্থিতিতে চুক্তিপত্র দুটি স্বাক্ষর করে বিনিময় করা হয়। চুক্তি দুটির একটি হলো, ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট। আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) চুক্তি।
ইআরডি সচিব শরিফা খান ও এজেন্স ফ্রান্সেইস দো ডেভেলপমেন্ট (এএফডি)’র কান্ট্রি ডিরেক্টর বোনুই শসেত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথম চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন বিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ও স্পেস সিস্টেম, এয়ারবাসের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ভেসভাল।
দেশের প্রথম জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশনস অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, ফরাসি কোম্পানি থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের নির্মিত। এটি ২০১৮ সালের ১২ মে উৎক্ষেপণ করা হয়।
সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়। এ সময় ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফররত ফ্রান্স প্রতিনিধি দলের সদস্যদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার পাঁচ দশকের অধিক সময় চলমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আজ ঐতিহাসিক একটি দিন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে আমার সার্বিক বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নের সার্বভৌমত্বকে সম্মান ও সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার এই নতুন কৌশলগত অগ্রযাত্রা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমরা উভয়েই আশাবাদী’।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ফ্রান্স আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে তার সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কৌশলগত সুরক্ষা অবকাঠামো বিনির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত কারিগরি সহায়তা প্রদানে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নেতৃস্থানীয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে’।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের অগ্রণী ভূমিকাকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায় এবং এ লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে একটি টেকসই তহবিল গঠনে ফ্রান্সের আহ্বানকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও ফ্রান্সের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা বিনিময়ের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই সফরের সামগ্রিক বিষয়ে একটি যৌথ-বিবৃতি খুব শিগগির প্রকাশ করা হবে এবং দুই দেশের সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় আপনাদের আরও বিস্তারিত অবহিত করা হবে’।
এর আগে ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এ সময় জাতির পিতার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও তাঁর ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি উপস্থিত ছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখেন মাখোঁ। জাদুঘরের সংরক্ষিত পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন তিনি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ রাষ্ট্রীয় সফরে গতকাল রবিবার রাতে ঢাকায় পৌঁছেছেন। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর ভারতের নয়াদিল্লি থেকে তিনি ঢাকায় আসেন।
মাখোঁকে বহনকারী বিশেষ উড়োজাহাজটি গতকাল রাত ৮টা ১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে ফুলের তোড়া দিয়ে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। রাষ্ট্রীয় অতিথিকে সেখানে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ফরাসি প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার দেয়। এ সময় ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। বাজানো হয় উভয় দেশের জাতীয় সংগীত।
ইমানুয়েল মাখোঁ গতকাল তাঁর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত এক রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আজ সোমবার (১১ সেপ্টে¤ৃ) তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেন। দুই নেতা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, ফরাসি বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবেন বলে কূটনীতিকেরা জানান। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ও তাঁদের আলোচনায় ছিল বলে জানা গেছে।
বড় উড়োজাহাজের জন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে চলতি বছরের শুরুর দিকে সরকার ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানি থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক সংহত করতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই সফর বলে ঢাকায় দেশটির দূতাবাস জানায়।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর প্রধানত দেশটির বাণিজ্যিক স্বার্থে। ভারত মহাসাগরে দেশটির ভৌগোলিক ও সামরিক উপস্থিতি আছে। তাই বর্তমান বৈশ্বিক জটিল পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে দেশটির ভূকৌশলগত স্বার্থও আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০২১ সালের নভেম্বরে প্যারিস সফরে দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্রে সই করে। মাখোঁর ঢাকা সফরে প্রতিরক্ষা খাতে সাধারণ সহযোগিতার পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের আলোচনা আরও এগোনোর সম্ভাবনা আছে বলে জানান কূটনীতিকেরা।
ফ্রান্স বাংলাদেশের কাছে যুদ্ধবিমানসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম বিক্রিতে আগ্রহী বলে শেখ হাসিনার ফ্রান্স যাওয়ার আগে ২০২০ সালের মার্চে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা সফর করেন। দেশটির কর্মকর্তারা তখন বাংলাদেশের কাছে রাফায়েল জঙ্গিবিমান বিক্রির প্রস্তাব দেন।
মাখোঁ ফ্রান্সের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি বাংলাদেশে এসেছেন। এর আগে ১৯৯০ সালে এসেছিলেন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ৩৩ বছর পর প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের এই সফর দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাবে।
মিতেরার সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ২১ কোটি ডলার মূল্যমানের। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়ে থাকে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ