আতঙ্কে তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
মানবাধিকার ইস্যু ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এবার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) বাংলাদেশকে দেওয়া শুল্ক সুবিধা পুনর্বিবেচনা করতে পারে। এসব গুঞ্জনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বেশ উদ্বিগ্ন।
বিদ্যমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের ভাবনা জানতে গতকাল তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে আজকের পত্রিকা। তাঁরা সবাই বলেছেন, যা শোনা যাচ্ছে তা কোনোভাবেই ব্যবসায়ীদের জন্য সুখকর নয়। বিশেষত ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের পোশাক খাতের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এখন পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনায় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তারপরও ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কায় আছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘দেশের যা পরিস্থিতি তাতে আমি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছি। চারদিক থেকে চাপে আছি। মালিকদের চাপ, ক্রেতাদের চাপ। ফোনের পর ফোন আসছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে’।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি বছরের এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো বড় বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেশি হওয়ায় নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যের দেশগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর জেরে মানুষ নন ফুড আইটেম, যেমন পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে পোশাক রপ্তানিতে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ।
ইউরোপের বাজারে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে দেওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা পুনর্মূল্যায়নের যে প্রস্তাব ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে উঠেছে তাতে পোশাক রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘ইউরোপে যদি শুল্ক দিয়ে পোশাক রপ্তানি করতে হয় তাহলে আমাদের রপ্তানি ধসে পড়বে। আমাদের পোশাক রপ্তানি আর টিকবে না। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা কোনোভাবে ইউরোপের বাজারে শুল্কারোপ মেনে নিয়ে পোশাক রপ্তানি করতে পারব না’।
সামনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কায় বাংলাদেশে অর্ডার দিতে বায়ারদের মধ্যে দ্বিধা কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। তাঁরা জানিয়েছেন, ক্রেতাদের শঙ্কা হচ্ছে, পোশাকের ক্রয়াদেশ দিলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হলে ঠিকমতো জাহাজীকরণ কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া বায়ারদের মধ্যে আরও একটি ব্যাপার কাজ করছে, তা হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞায় পড়লে তাঁদের ব্যবসাও ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এবং তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘দেশের এখন যে সমস্যাটা আছে সেটা রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক। এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবিশেষের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার কানাঘুষা চলছে, সেটা আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর নয়। যেই সমস্যাটা এখন বিদ্যমান সেটা সরকারি পর্যায়ে সুরাহা করতে হবে’।
ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের ওপর শুল্কহার বসানো হলে কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই বাজারে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই তাতে আমাদের পণ্য দামের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে মূল্য সংবেদনশীল থাকে। এখন শুল্ক আরোপ করলে ইউরোপের বাজার আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। যেটা আমাদের তৈরি পোশাক খাত নিতে পারবে না’।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মুদ্রাস্ফীতি ২ শতাংশে না নামা পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাবে না। ফলে মানুষ শিগগিরই অতিরিক্ত ব্যয়ের দিকে যাচ্ছে না। এই অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে পোশাক রপ্তানি আরও হোঁচট খাবে, এমনটাই ধারণা অর্থনীতিবিদদের।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানবাধিকার ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউরোপ যদি তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ করে তাহলে এটা হবে বাংলাদেশের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
শ্রম আইন সংশোধন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে দিন দিন চাপ বাড়ছে। একই সঙ্গে ইপিজেড এলাকায় যদি শ্রমিকদের শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার দেওয়া না হয় তাহলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সমস্যায় পড়বে বলে বিজিএমইএকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাইলে অনেক বিষয়কে সামনে এনে আমাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। এই জন্য সরকারের উচিত তাদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয়গুলো সমাধান করা’।
ইউরোপে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা। ইউরোপের বাজারে কোনো দেশ তাদের মোট রপ্তানির সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি রপ্তানি করলে জিএসপি সুবিধা পায় না। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০ শতাংশ ছাড়ালেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এত দিন জিএসপি সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি করে আসছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন সমস্যার কারণে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুবিধা উঠিয়ে দিতে পারে বলে মনে করেন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম।
তিনি বলেন, ‘সুসম্পর্ক থাকায় আমরা এত দিন রপ্তানির কোটা অতিক্রম হওয়ার পরও শুল্কসুবিধা পাচ্ছিলাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউরোপ যদি জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করে তাহলে আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি হবে’।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ