মুসলিম গণহত্যার দিকে এগোচ্ছে মোদির ভারত?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কয়েক বছর আগে ‘ডিভাইডার ইন চিফ’ বলে ব্যঙ্গ করেছিল বিখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিন। অর্থাৎ, ওই পত্রিকার মতে, মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে মোদির জুড়ি নেই। এবার ওই ম্যাগাজিনের একটি কলাম আরো মারাত্মক। তাতে বড় শিরোনামে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘ভারত কি তবে মুসলিম গণহত্যার দিকে এগোচ্ছে?’ পুরো কলামে সমালোচনা করা হয়েছে মোদিকে। প্রবন্ধ লেখকের বক্তব্য, ভারতের নেতৃত্ব গান্ধীজির আদর্শ থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত হয়েছে।
প্রবন্ধের শুরুতে বলা হয়েছে, ভারতীয় নেতারা বিদেশে গিয়ে ঘন ঘন গান্ধীর নাম নেন। অনেকের ধারণা, ভারত হল শান্তি ও প্রেমের দেশ। বর্তমান বিশ্বে যে ক’টি দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক দেশ আছে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। দেড় বছর বাদে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশযাত্রা করেছেন। তখনও তিনি গান্ধী ও তার মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন একাধিকবার।
এরপরে কলামে মোদির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবন্ধকার লিখেছেন, ২৪ সেপ্টেম্বর মোদি হোয়াইট হাউজে যান। সেখানে বাইডেন বলেন, ‘গান্ধী যে অহিংসা, সম্মান ও সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, তা আগের চেয়ে বেশি বর্তমানে বেশি প্রাসঙ্গিক।’ মোদি নিজেও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেয়া ভাষণে দুঃখ করে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে পশ্চাৎপদ চিন্তা এবং সন্ত্রাসবাদের বিপদ দেখা যাচ্ছে।’ ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ওপরেও বিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি ভারত সম্পর্কে নতুন তকমা ব্যবহার করেন, ‘মাদার অব অল ডেমোক্র্যাসিজ’, অর্থাৎ, সব গণতন্ত্রের জননী।
টাইম ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছে, কেউই জানে না ওই নতুন তকমার প্রকৃত অর্থ কী? অন্তত যে ভারতীয় জননীর ১২ বছরের ছেলে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে, তিনি তো জানেন না।
এখানে আসামে বিজেপি সরকারের উচ্ছেদ অভিযানের কথা বলেছেন টাইম ম্যাগাজিনের প্রবন্ধকার। ওই অভিযানে এক ১২ বছরের বালক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্রে অহিংসার কথা বলছেন, তখন ভারতের উত্তর-পূর্বে আসাম রাজ্যে ওই বালক মারা পড়ে।
নিহত বালকের মায়ের নাম হাসিনা বানু। টাইম ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছে, তিনি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা আমার ছেলেকে খুন করেছে’।
প্রবন্ধ লেখকের বক্তব্য, আসামে বাঙালি মুসলিমদের জমি কেড়ে নিয়ে সরকার তা হিন্দুদের দিতে চেয়েছিল। হিন্দুদের সরকার বলছে ‘ভূমিপুত্র’। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, পুলিশ তাদের ওপরে গুলি চালায়। তখনই শেখ ফরিদ নামে ওই বালকটি মারা যায়। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই সে পোস্ট অফিস থেকে নিজের ন্যাশনাল বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন কার্ড সংগ্রহ করেছিল। ওই কার্ড তার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দেয়।
লেখক এরপর সরাসরি বলেছেন, বালকটি যেভাবে মারা গিয়েছে, তা ভারতের জাতীয় লজ্জা। পুলিশ অন্ধ আক্রোশে ফরিদের প্রতিবেশীদের লাঠিপেটা করেছে। পাঁচ হাজার লোকের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মইনুল হক নামে আর এক ব্যক্তি গুলিতে মারা গিয়েছেন। পুলিশরা তার চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল। তাকে সহজেই গ্রেফতার করা যেতে পারত। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে খুব কাছ থেকে গুলি করে মারা হয়েছে।
ঘটনার ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, মইনুল মারা যাওয়ার পরও পুলিশ তার দেহের ওপরে লাঠি দিয়ে মারছে। পুলিশ টিমের সঙ্গে ছিল বিজয় বানিয়া নামে এক হিন্দু ফটোগ্রাফার। সে মৃতদেহের ওপরে বারবার লাফিয়েছে। ঘৃণা প্রকাশ করার জন্যই সে ওই কাজ করেছিল।
এর পরে প্রবন্ধে লেখা হয়েছে, ভারতের ৮৪ শতাংশ মানুষ হিন্দু। সেদেশে জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ মুসলিম। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি আশ্চর্যজনক সাফল্যের সঙ্গে হিন্দুদের বুঝিয়েছে, তারা অত্যাচারিত হচ্ছে। ভুয়ো তথ্য, ঘৃণাপূর্ণ ভাষণ, পুরানো ধর্মীয় বিরোধ উস্কে তোলা, মিডিয়াকে নানাভাবে প্রভাবিত করা ইত্যাদি উপায়ে তারা মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে ‘হিন্দু খতরেঁ মে হ্যায়’।
এর ফলে বহু হিন্দু এখন মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মুসলিমরা। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার আগে বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতেন, দেশের প্রধান সমস্যা হল বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বিকাশের ধীর গতি ও দুর্নীতি। মোদি আশ্বাস দিয়েছিলেন, এই সমস্যাগুলির সমাধান করবেন। কিন্তু তাঁর আমলে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। বিজেপি মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ওপরে নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
বিজেপির সমালোচনা করে টাইম ম্যাগাজিনের প্রবন্ধকার লিখেছেন, তারা প্রচার করে, মুসলিমরা হিন্দু নারীদের প্রতি খারাপ দৃষ্টি দেয়। তারা ভবিষ্যতে সংখ্যায় হিন্দুদের চেয়ে বেড়ে যাবে। একসময় তারা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। ভারতে এখন ‘লাভ জেহাদ’, গোহত্যা এবং ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি নিয়মিত মুসলিম হকার ও শ্রমিকদের আক্রমণ করছে। মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কট করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
প্রবন্ধের শেষে বলা হয়েছে, “ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দুত্বের স্বঘোষিত রক্ষকরা প্রচুর ভিডিও পোস্ট করে। তাতে মুসলিমদের পিটিয়ে মারার আহ্বান জানানো হয়”।
টাইম ম্যাগাজিনের বক্তব্য, মুসলিমদের মারার ঘটনা এখন এত ঘন ঘন ঘটে যে ভারতে তা খবর হিসাবেই গণ্য করা হয় না। সেদেশে কাউকে ‘মুসলিমদের মতো দেখতে’ হলেই মানুষ উত্তেজিত হতে পারে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, যারা অশান্তি সৃষ্টি করছে, দেখলেই বোঝা যায় তারা মুসলিম। সূত্র: দ্য ওয়াল

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ