দেউলিয়া হওয়ার পথে শ্রীলঙ্কা!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
বড় ধরণের আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি থাকা শ্রীলঙ্কা আশঙ্কা করছে, ২০২২ সালে দেউলিয়া হতে পারে দেশটি।  রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
অর্থনৈতিক এই পতনের মুখোমুখি থাকা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা।  এই সংকটের জন্য করোনা ভাইরাস মহামারি আংশিকভাবে দায়ী।  পর্যটন খাতের লোকসানেরও ভূমিকা রয়েছে।  কিন্তু সামগ্রিকভাবে উচ্চ ব্যয় ও কর কর্তনের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব কমেছে, চীনের কাছে বড় ঋণ এবং কয়েক দশকের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।  দেশি ঋণ ও বিদেশি বন্ডের টাকা শোধ করতে সরকার টাকা ছাপানোর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এসেছে সেখানে।
নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১১.১ শতাংশ ছুঁয়েছিল।  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একসময় সচ্ছল মানুষেরাও তাদের পরিবারের ভরণপোষণে হিমশিম খাচ্ছেন।  অনেকের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সামর্থ্যও নেই।  রাজাপাকসা অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সেনাবাহিনীকে চাল ও চিনির মতো আবশ্যক পণ্য বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।  তবে এতে জনগণের দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি।
কলম্বোর গাড়িচালক অনুরুদ্ধ পারানাগামা পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য ও গাড়ি কেনার ঋণ শোধ করতে আরেকটি কাজ শুরু করেছেন।  এরপরও পোষাচ্ছে না।  তার কথায়, ঋণ পরিশোধ করা আমার জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।  বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ, খাবার কেনার পর কোনো টাকাই থাকছে না।
তিনি জানান, তার পরিবার এখন তিন বেলার বদলে দুই বেলা খাবার খায়।  গ্রামের মুদির দোকানে ১ কেজির প্যাকেট কেনার মতো সামর্থ্য নেই কারও।  তাই ১০০ গ্রামের ছোট ছোট প্যাকেট করা হয়।
অনুরুদ্ধ বলেন, আমরা এখন ১০০ গ্রাম মটরশুটি কিনছি।  অথচ আগে আমরা সপ্তাহে ১ কেজি কিনতাম।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, চাকরি হারানো এবং পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব আয় না থাকা এই সংকটের কারণ।  এই খাতের ২ লক্ষাধিক মানুষ কাজ হারিয়েছেন।  শ্রীলঙ্কার জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আসে পর্যটন খাত থেকেই।  পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে যে প্রতি চার জনের একজন পাসপোর্ট অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন।  বেশিরভাগ তরুণ ও শিক্ষিত।  তারা দেশ ছাড়তে চান।  বয়স্কদের কাছে এটি ১৯৭০-এর দশকের মতো।  যখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও দেশে উৎপাদন ঘাটতির কারণে রুটি, দুধ ও চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ বিজেওয়ার্ডেনা সতর্ক করে বলছেন, সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা আর্থিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে।  ফলে তাদের জীবন-জীবিকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, যখন মানুষের আর্থিক সংকট মোচনের অযোগ্য হয়ে যায় তখন দেশও যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে তা অনিবার্য।  উভয় ক্ষেত্রেই কম উৎপাদন এবং বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমদানিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস পায়।  তখন তা একটি মানবিক সংকটে পরিণত হবে।
বড় বোঝা বিদেশি ঋণ
শ্রীলঙ্কার জন্য বড় বোঝা হলো তাদের বিদেশি ঋণ।  বিশেষ করে চীনের কাছে তাদের অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।  চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার ৫০০ কোটি ডলার দেনা রয়েছে।  গত বছর বেইজিংয়ের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে কলম্বো।  আগামি ১২ মাসে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে দেশি ও বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে ৭৩০ কোটি ডলার।  এরমধ্যে জানুয়ারিতেই আন্তর্জাতিক বন্ডের জন্য ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।  যদিও নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার।
অর্থমন্ত্রী রমেশ পাথিরানা জানান, চা বিনিময় করে ইরানের তেলের ঋণ শোধ করার বিষয়ে আশাবাদী সরকার।  অতি প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডলারের চা পাঠানো হচ্ছে।
বিরোধীদলীয় এমপি ও অর্থনীতিবিদ হার্শা ডি সিলভা সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে বলেছেন, জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি থাকবে ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশি ঋণ দাঁড়াবে ৪৮০ কোটি ডলার। তিনি বলেন, পুরো দেশ একেবারে দেউলিয়া হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিত নিভার্দ চাবরাল ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করলেও বিজেওয়ার্ডেনা বলছেন, ঋণ পরিশোধে দেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যেটির ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণতি থাকবে। সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ