তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

বান্দরবান প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
মিয়ানমারে আকাশ, স্থল ও নৌপথে তুমুল সংঘর্ষ চলছে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মাঝে। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাদের আর মাত্র দুটি সীমান্ত চৌকি টিকে আছে। এর মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নৌকা করে নাফ নদীতে অবস্থান করছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) রোহিঙ্গাদের কোনো বাধা দিচ্ছে না। এতে ওই এলাকায় বাংলাদেশিদের মাঝে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বিজিবি।
জানা গেছে, সীমান্তের ৩৪ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকা থেকে ৫৫/৫৬ নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটারের ৯০ শতাংশ সীমান্ত এলাকা বিদ্রোহী আরকান আর্মিদের দখলে রয়েছে। দীর্ঘ দুই বছর লড়াইয়ের পর এখন বাকি মাত্র ৫ কিলোমিটার এলাকা দখলে নেওয়া বাকি রয়েছে তাঁদের। যেখানে মিয়ানমার অংশে সরকারি বাহিনীর সীমান্ত চৌকি রয়েছে ২টি মাত্র। এই দুইটি পয়েন্টের ১টি হলো তুমব্রু রাইট ক্যাম্প।
বাংলাদেশ অংশের তুমব্রু গ্রামের ওপারেই ক্যাম্পটি অবস্থিত। গত ২৯ জানুয়ারি থেকে এ ক্যাম্পটি আয়ত্তে নিতে রাইট ক্যাম্পে থাকা সেনাদের লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে আরকান আর্মি। জবাবে সেনারাও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। দুই বাহিনীর মাঝখানে রয়েছে কোনারপাড়া, তুমব্রুপাড়া, ক্যাম্প পাড়া ও তুমব্রু বাজার।
তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গোলাগুলি শুরু হলে সেখানকার ৪ পাড়ার লোকজন নিরাপদে আশ্রয়স্থলে ছুটে যায়। আর গোলাগুলি বন্ধ হলে আবার নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে আসে। এ ছাড়া আশপাশের অন্তত ৬ পাড়ার মানুষ গোলাগুলির আওয়াজে ভয় পান। গোলাগুলিতে তাঁদের বাড়িঘরেও মর্টারশেল এসে পড়ে। এরই মধ্যে ৪টি মর্টারশেলের খোসা আশপাশের গ্রামের বাড়ির উঠান ও ধানখেতে দেখে বিজিবির কাছে খবর দেওয়া হয়েছে। পরে বিজিবি এসে সেগুলো সংগ্রহ করেছে।
বিভিন্ন সূত্র জানা গেছে, ঘুমধুম ও সোনাইছড়ি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ছোট ছোট দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। অনুপ্রবেশকারীদের অনেকেই নানা কৌশলে আগেই বাংলাদেশের ভোটার হয়েছিল।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘অন্তত কয়েকশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার খবর আমার কাছে রয়েছে। যাদের মধ্যে মুসলিম উপজাতি, বড়ুয়া ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন। এদের মধ্য থেকে অনেককে আমি চিনি’।
এদিকে বিজিবি সূত্র দাবি করেছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে করার সময় বেশ কয়েক দফা অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছে তাঁরা। এর মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার ঘুমধুম বাইশফাড়ী বিওপির বিশেষ টহল দল মিয়ানমারের এক উপজাতি নারী উখসওনো চাকমাকে ২ সন্তানসহ আটক করে। সীমান্তের ৩৭ নম্বর পিলারের মগপাড়া ব্রিজ এলাকা দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে তাঁকে আটকের ২ ঘণ্টা পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠান তাঁরা। তিনি মিয়ানমারের মংডু জেলার বাসিন্দা বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া ৩০ জানুয়ারি ঘুমধুম রেজুআমতলী সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় মংপ্রুশি মারমা (২০) নামে এক মিয়ানমারের নাগরিককে আটকের চার ঘণ্টা পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।
এদিকে সীমান্তের পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। আজ বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় মহড়া দিয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজার থেকে হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া বুধবার সারা রাত এবং বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত তুমুল সংঘর্ষ চলে। মর্টারশেল ও ভারী অস্ত্রের গোলাগুলিতে তটস্থ ছিল তুমব্রু এলাকার ১০ পাড়ার মানুষ।
তুমব্রু খোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের আশায় মিয়ানমারের মংডু ও বলিবাজার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে বেশ কিছু রোহিঙ্গা। আবার কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নৌকা করে নাফ নদীতে অবস্থান করছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) রোহিঙ্গাদের কোনো বাধা দিচ্ছে না। এতে বাংলাদেশ লোকজনের মাঝে সীমান্তে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৭ সালে এ ধরনের সংঘাতে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করে। যারা সীমান্তের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারে আবারও উত্তেজনা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাস করা মানুষেরা। ইতিমধ্যে অনেক মানুষ ঘর ছেড়েছে। মিয়ানমারে উত্তেজনা শুরু হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে শঙ্কা থাকে। শুনেছি কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের কাছাকাছি আছে। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।
বিজিবি কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪) অধিনায়ক জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে বিজিবি। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আমরা সব সময় সজাগ আছি’।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলি হচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজিবিকে সতর্ক করা হয়েছে’।

ডিসি/এসআইকে/এসপিআর