হেফাজতের নতুন কমিটিতে রাখা হবে না যেসব নেতাদের, তবে…. 

বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
সরকারের সাথে সমঝোতার অংশ হিসেবে সোয়া চার মাসের মাথায় বিলুপ্ত করা হয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র জাতীয় কমিটি।  রবিবার (২৫ এপ্রিল) রাত ১১ টার দিকে কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তের ঘোষণা দেন সংগঠনের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী।  তিনি জানান, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
যদিও হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, গত ১১ এপ্রিল থেকে সারাদেশে হেফাজত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, আলেমদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ এবং কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবেই বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।  একইসঙ্গে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও বাদ দেওয়া হতে পারে সম্ভাব্য নতুন কমিটি থেকে।
এদিকে, হেফাজতের সদ্য কমিটি থেকে বাদপড়া সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা চাইছে, নতুন যে কমিটি হবে, সেখানে তাদের নিয়ে একসঙ্গে কমিটি গঠন করা।  তারা চাইছেন, আলোচনার মাধ্যমে বিভক্ত হেফাজতকে ঐক্যবদ্ধ করতে।
২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর গঠিত কমিটি বিলুপ্ত করার কয়েকঘন্টা পরই রবিবার (২৫ এপ্রিল) রাতে তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে হেফাজত।  এতে মুহিববুল্লাহ বাবুনগরী উপদেষ্টা, জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক, নুরুল ইসলাম জিহাদীকে সদস্য সচিব করা হয়।  পরে আবার দেড়ঘণ্টার মাথায় রাত সাড়ে চারটার দিকে আরও দু’জনকে আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়।  এই দু’জন হলেন সালাউদ্দিন নানুপুরী ও মিজানুর রহমান চৌধুরী।
হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হেফাজতের নেতৃত্বে যারা থাকবেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের আর সম্পৃক্ত করা হবে না।  অর্থাৎ নতুন যে কমিটি হতে যাচ্ছে তাতে থাকার সুযোগ থাকবে না বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকা নেতারা।  গত কমিটিতে রাবেতাতুল ওয়ারেজিন নামে বক্তাদের একটি সংগঠনের প্রাধান্য থাকলেও রাজনীতিকরা নিয়েছেন অধিকাংশ পদ।
হেফাজতের একাধিক নেতা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও বাদ দেওয়া হতে পারে।  বিশেষ করে শীর্ষ পদগুলোতে ‘অরাজনৈতিক নেতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা হতে পারে।
সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে তিনটি শর্তে সমঝোতার পথে আসার চেষ্টা করছে হেফাজত।  এরমধ্যে হেফাজতের কমিটি ভেঙে দেওয়াও ছিল এ শর্তে।  এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের বের করে অরাজনৈতিক নেতাদের যুক্ত করার শর্তও রয়েছে।  সেক্ষেত্রে সদ্য সাবেক কমিটির প্রায় অর্ধেকের বেশি নেতা নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়তে পারেন।
সদ্য বিলুপ্ত কমিটিতে যেসব নেতা ছিলেন তাদের মধ্যে ২০ দলীয় জোটভুক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (কাসেমী অংশ) ৩৪ জন কেন্দ্রীয় নেতা জায়গা পান।  দলের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী হেফাজতের নতুন কমিটির মহাসচিব হিসেবে মনোনীত হন।  তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর করোনায় মারা গেলে নুরুল ইসলাম জিহাদিকে মহাসচিব করা হয়।  হেফাজতের উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা পেয়েছিলেন জমিয়ত নেতা মাওলানা জিয়াউদ্দীন, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক।  নায়েবে আমির পদে জমিয়তের ছিলেন, মাওলানা আব্দুল হামিদ (মধুপুর) মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সাদী, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, মাওলানা আনোয়ারুল করিম (যশোর) ও মাওলানা নুরুল ইসলাম খান (সুনামগঞ্জ)।
চার জন যুগ্ম মহাসচিবের দুজন ছিলেন জমিয়তের।  তারা হলেন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির।  সহকারী মহাসচিবের তালিকায় জায়গা পান জমিয়ত নেতা মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।  সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান দলটির মাওলানা মাসউদুল করীম টঙ্গী, মাওলানা শামসুল ইসলাম জিলানী ও মাওলানা তাফহিমুল হক হবিগঞ্জ।  এছাড়া হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিলেন, মুফতি মুনির হোসাইন কাসেমী (অর্থ সম্পাদক), মাওলানা লোকমান মাজহারী (সহকারী অর্থ সম্পাদক), মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী, মুফতি শরীফুল্লাহ ও মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান নারায়ণগঞ্জ (সহকারী প্রচার সম্পাদক), মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী (আইন বিষয়ক সম্পাদক), মাওলানা নাজমুল হাসান (দাওয়াহ সম্পাদক), মাওলানা শুয়াইব আহমদ, মাওলানা গোলাম কিবরিয়া লন্ডন (সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক), মাওলানা সিদ্দিকুল ইসলাম তোফায়েল (সহকারী দফতর সম্পাদক)। জমিয়ত থেকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন, জামিল আহমদ চৌধুরী মৌলভীবাজার, বশির আহমদ মুন্সীগঞ্জ, তাফাজ্জুল হক আজিজ সুনামগঞ্জ, আলী আকবর সাভার, আবু আব্দুর রহিম নরসিংদী, আব্দুল কুদ্দুস মানিকনগর, মুহাম্মদ উল্লাহ জামি, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী।
হেফাজতে ইসলামের সদ্য সাবেক কমিটিতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিসের (২০ দলীয় জোটভুক্ত) অন্তত ২০-২২ জন কেন্দ্রীয় নেতা জায়গা পান।  সংগঠনের বিভিন্ন পদে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসমাঈল নূরপুরী (উপদেষ্টা), সাবেক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক (নায়েবে আমির), ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক (যুগ্ম মহাসচিব), মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী ও মাওলানা জালালুদ্দিন (সহকারী মহাসচিব), যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন (সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক), মাওলানা ফয়সাল আহমদ (সহ-প্রচার সম্পাদক ) ছিলেন।  এছাড়া দলটির বেশ কয়েকজন ভক্ত ও অনুসারী আলেম জায়গা পান হেফাজতের বিভিন্ন পদে।
হেফাজতের সদ্য সাবেক কমিটিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের ছয় জন নেতা স্থান পেয়েছিলেন।  এদের মধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে দলের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, নায়েবে আমির পদে মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে হজরত মাওলানা আবদুল কাদের সালেহ ও আহমদ আলী কাসেমী উল্লেখযোগ্য।  এছাড়া, নায়েবে আমির পদে মাওলানা সারওয়ার কামাল আজিজী (নেজামে ইসলাম), মাওলানা জাফরুল্লাহ খান (খেলাফত আন্দোলন) রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত।
উপরোক্ত সকল রাজনৈতিক নেতারা বাদ পড়লেও সম্ভাব্য নতুন কমিটিতে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী (নায়েবে আমির), মাওলানা মাহফুজুল হক (নায়েবে আমির), মাওলানা সাজিদুর রহমান (নায়েবে আমির)-সহ সরকারঘেঁষা অনেক আলেমই স্থান পেতে পারেন বলে হেফাজতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
আলোচনায় আগ্রহী আল্লামা শফীপন্থী আলেমরা
হেফাজতে ইসলামের আল্লামা আহমদ শফীপন্থী আলেমরা জানিয়েছেন, হেফাজতের বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়ায় নতুন করে হেফাজতকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ এসেছে।  বিশেষ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকাল ও তার আগে-পরে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা সহজ হবে।  একইসঙ্গে যেসব শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের সসম্মানে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটিও শুরু হবে।
গ্রেফতার এড়ালেন বাবু নগরী
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থার সূত্র বলছে, রবিবার (২৫ এপ্রিল) রাতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা থেকেই হাটহাজারী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল জমায়েত করা হয়েছিল।  তবে কমিটি ভেঙে দেওয়ার কারণে গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয়নি বাবুনগরীকে।
তবে, রাষ্ট্রের প্রভাবশালী আরেকটি সংস্থার সূত্র বলছে, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আইনের আওতায় আনা হবে।  ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা ও মানুষের প্রাণহানি, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যু-মামলা ও ২০১৩ সালে শাপলা চত্বর কেন্দ্রিক যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলোতে তাকে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে।  সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও দুটো মামলা করা হয় হাটহাজারী থানায়।
সূত্রের দাবি, হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনায় আবারও শফীপন্থীদের সামনে আনা হবে এবং হেফাজতের নেতৃত্বে শফীপন্থীরা প্রাধান্য পাবে।  জানতে চাইলে আহমদ শফীর সন্তান মাওলানা আনাস মাদানীর ঘনিষ্ঠ, হেফাজতের প্রথম কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী বলেন, হেফাজতে ইসলাম মিলেমিশে হোক, এটাই আমরা চাই।  আলেমদের মধ্যে কোনো বিভাজন না থাকুক, সবাই যেন আল্লামা আহমদ শফীর পথে ফিরে আসুক, এটাই চাই।  সবার ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে বলে উদাত্ত আহ্বান জানাই।  মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী আরও বলেন, হেফাজতে ইসলাম আল্লামা শফীর নীতি-আদর্শে ফিরে আসুক, আবারও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করুক, আমরা চাই। আমরা আলোচনা শুরু করবো।  সবাই মিলে একটি বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক, আলেমদের মধ্যে বিবাদের অবসান হবে বলে আমি আশা করি।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ‘নতুন কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে কবে, এটা আরও সময়সাপেক্ষ।  এটা এখনও আলোচনা হয়নি’।
প্রসঙ্গত, নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম।  ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে দ্বিতীয়বারের মতো কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে হেফাজতে ইসলাম।  ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালের কারণে নতুন এ কমিটি করেছিল হেফাজত।  এরপর ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী মারা গেলে নায়েবে আমির মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান।  রবিবার (২৫ এপ্রিল) রাতে সংগঠনটির দ্বিতীয় কমিটি বিলুপ্ত করলেন আমির বাবুনগরী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের বিরোধিতা করে দেওয়া হেফাজতের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে সহিংস ঘটনা ঘটে।  এতে অন্তত ১৭ জন নিহত হয়।  পরে গত ১১ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মামলায় হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  রবিবার পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় অন্তত ১৮ জন নেতা ও সারাদেশে অন্তত দুই শতাধিক নেতা-কর্মী ও সমর্থক গ্রেফতার হয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/সিসি