রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত ফকির আলমগীর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
হাসপাতালের মর্গ থেকে নির্ধারিত কবরস্থানের দূরত্ব যতোই হোক, সেটা অবধারিত।  পরিকল্পনায় মাঝে ছিলো, খিলগাঁওয়ের পল্লীমা সংসদে প্রথম জানাজার বিরতি।  কারণ, সেখানেই এই কিংবদন্তির নাগরিক তথা সংগীত জীবনের শুরু ও শেষ।
তবে শুক্রবার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এই সূচিতে খানিক পরিবর্তন এনেছেন পরিবারের সদস্যরা।  কারণ, সরকার তথা শীর্ষরা চাইছিলেন সবার প্রিয় ফকির আলমগীরকে শেষ শ্রদ্ধা কিংবা বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা যথাযথ করতে।  সিদ্ধান্ত হলো, শনিবার বেলা ১২ টায় এই সূর্যসন্তানকে বিদায় জানানো হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে।
শনিবার (২৪ জুলাই) ঠিক বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হলো ঝিরঝির বৃষ্টি।  যথাসময়ে এলেন জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে, নিথর ফকির আলমগীর।  গাড়ি থেকে বেদিতে আসার আর পথে ভিজলেন তিনিও।  ভিজলো তার জন্য আগত শতাধিক বন্ধু-স্বজন-ভক্ত-মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী।  বিস্ময়, এতো এতো মুখের ভিড়ে উল্লেখ কিংবা অনুল্লেখযোগ্য কোনো সংগীতশিল্পীকে চোখে পড়েনি!  হতে পারে প্রতিবেদকের বিভ্রম!  তবে অন্যদের কাছেও খোঁজ মিলেছে, না সংগীতের কেউ আসেনি এদিন!

শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে রাখা ফকির আলমগীরের মরদেহ।

তবে এসেছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই।  এরমধ্যে রয়েছেন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদস্যরাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সদস্যরা।
সরাসরি না এলেও গভীর শোক ও ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ্য পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।  শুধু দেখা যায়নি সংগীতাঙ্গনের তেমন কোনো ব্যক্তিকে!
ফকির আলমগীরের সহধর্মিণী সুরাইয়া আলমগীরের অবশ্য এসব নিয়ে আক্ষেপ বা ক্ষোভ নেই।  বরং তিনি নাম ধরে ধরেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বৃষ্টিতে ভিজে যারা এসেছেন।  বলেছেন কিছু কষ্ট আর প্রত্যাশার কথাও।  বললেন, ‘এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আর ফকির আলমগীরের কণ্ঠে মুখরিত হবে না।  তার মতো বিপ্লবী কণ্ঠে উদ্ভাসিত হবে না এই প্রান্তর।  তিনি চলে গেছেন সব বন্ধন ছিন্ন করে।  যে গণসংগীতের মশাল এতোদিন বয়ে চলেছেন ফকির আলমগীর, সেটি যেন এই প্রজন্ম রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় সেই প্রত্যাশা করছি।  যেন এই ধারার সংগীতের মাধ্যমে মেহনতি মানুষের কথা বার বার উচ্চারিত হয়’।
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে সুরাইয়া আলমগীর বলেন, ‘ফকির আলমগীর ছিলেন গণমানুষের শিল্পী।  তিনি যেমন সাধারণ লোকের জন্য শত শত গান করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গান বীর যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।  শোষণ, অন্যায়-অবিচারের কথা তিনি গানে গানে বলেছেন, তার মতো এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠযোদ্ধাকে যেন পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  যেন নতুন প্রজন্ম তার মতো একজন আদর্শ শিল্পীকে চিনতে পারে’।
জানান, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির জন্য ফকির আলমগীরের ভেতর একটা আফসোস ছিলো।  মরণোত্তর হলেও সেটা যেন তাকে দেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সেই অনুরোধ জানালেন ফকির পত্নী সুরাইয়া।
বেলা ১টা বাজার আগেই মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় খিলগাঁও মাটির মসজিদে।  সেখানে জোহরের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজা শেষে তালতলা কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।

তালতলায় সমাহিত করা হচ্ছে ফকির আলমগীরকে।

এর আগে বেলা ১১ টায় খিলগাঁও পল্লীমা সংসদের মাঠে ফকির আলমগীরকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হয়।
গতকাল শুক্রবার (২৩ জুলাই) রাত ১০টা ৫৬ মিনিটের দিকে প্রাণ হারান নন্দিত গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর।  করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৫ জুলাই মধ্যরাত থেকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফকির আলমগীর।  ১৮ জুলাই চিকিৎসকেরা তাকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেয়।
জানা গেছে, ১৪ জুলাই ফকির আলমগীরের করোনা ভাইরাস পজিটিভ ফল আসে।  এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।
ফকির আলমগীর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শিল্পী।  তারও আগে থেকে তিনি শ্রমজীবী মানুষের জন্য গণসংগীত করে আসছিলেন।  স্বাধীনতার পর পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন ফকির আলমগীর।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার কণ্ঠের বেশ কয়েকটি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।  এরমধ্যে ‘ও সখিনা’ গানটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।  ১৯৮২ সালের বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পর দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলে।  কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি গানটির সুরও করেছেন ফকির আলমগীর।
তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা, গণসংগীত চর্চার আরেক সংগঠন গণসংগীতশিল্পী পরিষদের সাবেক সভাপতি।  সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ