তারা নেই শিল্পীর স্বার্থেও

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
বিকাল গড়িয়ে তখনও সন্ধ্যা নামেনি; রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা তেজগাঁওয়ের সিনেমা রাজ্যে ভালোই জনসমাগম। কোনো ফ্লোরে শুটিং হচ্ছে বিজ্ঞাপনের, কোনো ফ্লোরে চলছে টিভি রিয়েলিটি শো। বিপরীতে সমিতির অফিসগুলোতে অদ্ভুত এক নীরবতা লক্ষ্য করা গেছে। বুঝি, সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায় কেউ কেউ। গত রবিবারে (২২ আগস্ট) বিএফডিসি’র চিত্র এটি।
যে চিত্রের বড় একটা অংশজুড়ে স্থির হয়ে আছে সিনেমা-শূন্যতা। বিএফডিসিতে অনেক মানুষ; নেই শুধু সিনেমার শুটিং বা নজরকাড়া কোনো নায়ক-নায়িকা-নির্মাতা-প্রযোজকের পদধ্বনি। সিনেমার খানিক রেশ পাওয়া গেলো ক্যান্টিনের আশপাশে। চলচ্চিত্রের কিছু বেকার শিল্পী-কুশলী গল্পে-আড্ডায় সময় পার করছেন অলস। ক্যান্টিনের পেছনেই চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি; ভেতরে কয়েকজন গল্পে মশগুল, বাইরে চেয়ার পেতে কয়েকজন নিচ্ছেন আলো নেভার আগে বিকালের শেষ ওম। পরিচালক সমিতির পরই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কার্যালয়। যে সংগঠনের প্রধানতম কাজ ‘শিল্পীদের স্বার্থরক্ষা করা’। কিন্তু বাংলা সিনেমার আলোচিত নায়িকা পরীমণি গ্রেফতারের পর প্রশ্ন ওঠে সমিতির এই প্রধান ‘কর্তব্য’ নিয়েও।
গত ৫ আগস্ট পরীমণি গ্রেফতারের পর ৭ আগস্ট ঘটা করে তার সদস্যপদ স্থগিত করে শিল্পী সমিতি। সমিতির অধিকাংশ সদস্যের আড়ম্বর উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত জানান নির্বাচিত নেতারা। এমন ঘটনায় দেশের প্রধান চিত্রনায়ক শাকিব খানও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এই শিল্পী সমিতির কাজ কী?’ জবাবে সম্ভবত এটাই আসে, ‘কাজ নাই তো খই ভাজ!’ অভিযোগ উঠেছে, পরীমণির বিপদে সেই খই ভাজার কাজটিই সততার সঙ্গে করে চলেছেন শিল্পী সমিতির বেকার নেতারা।
রবিবার সন্ধ্যায় শিল্পী সমিতির ভেতরেই পাওয়া গেলো সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য (অষ্টম) জয় চৌধুরীকে। সমিতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমেই বললেন, ‘শিল্পী সমিতির মূল কাজ শিল্পীদের স্বার্থ রক্ষা করা’। জয় চৌধুরী জানান, তিনি ১৬টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। বলেন, ‘১৬টি সিনেমার মধ্যে আমার ৭টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান। আর কিছু সেন্সরে জমা রয়েছে’।
যদিও মুক্তি পাওয়া ৭টি ছবির সবক’টি তুমুল বিফল; বাণিজ্যিক ও সমালোচক বিচারে। চলমান মহামারির কারণে বাকি ছবিগুলোর ভবিষ্যৎও অন্ধকারে ডুবে আছে বলে মনে করছেন বেশিরভাগ চলচ্চিত্রজন।
সমিতির কার্যালয়ে পাওয়া গেলো সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক জাকির হোসেনকে। অন্তর্জাল সংক্রান্ত কাজে মনোযোগী ছিলেন তিনি। আর কাউকে পাওয়া যায়নি সেদিন। পরে একাধিক সদস্যের সঙ্গে ফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে জরুরি কাজ ছাড়া সমিতিমুখী হন না তারা।
আলাপকালে সমিতির কয়েকজন সদস্য বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক সিনেমার শুটিং শুরু হলেও বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে কিছু ছবির কাজ আবার শুরু হতে পারে। তবে সমিতির পদভুক্ত অধিকাংশ সদস্যই সিনেমাশূন্য। সমালোচকরা বলছেন, দলবাজি বা সমিতিগিরি করলে শুটিং করার সময় থাকে না! তাছাড়া সিনেমায় বিফল হয়েই নাকি সমিতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন নেতারা!
২০১৯ সালে শিল্পী সমিতির বর্তমান কমিটি নির্বাচিত হয়। এ বছরের অক্টোবরে ২১ সদস্যের এই কমিটির মেয়াদ শেষ হবে। সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ছাড়া বাকি প্রায় প্রত্যেকেই সিনেমা ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। তথ্য বলে, গত চার বছরে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের ছবি মুক্তি পেয়েছে মাত্র দুটি! তার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে সফল ছবি নেই একটিও! অথচ তিনিই সমিতির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা বলে চিহ্নিত সবার কাছে।
কার্যালয়ে বসে সমিতির একজন সদস্য জানান, সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর নিয়মিত অভিনয় করলেও সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন ডিপজলের ব্যস্ততা সিনেমা পরিচালনা ও প্রযোজনায়। সেটিও অনিয়মিত। আরেক সহ-সভাপতি মাসুম পারভেজ রুবেলের হাতে কোনো সিনেমা নেই। আর সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ। এ কারণে কাজ করতে পারছি না’। আগামি মাস থেকে নিয়মিত কাজে ফিরবেন বলে জানান তিনি। তবে কাজের তালিকা এক অর্থে শূন্য।
সহ-সাধারণ সম্পাদক ফাইট ডিরেক্টর আরমান। যিনি লম্বা সময় ধরেই প্রায় বেকার। অভিনেতা সুব্রত রয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে; তিনি মূলত মাঝে মধ্যে অভিনয় করেন নাটকে। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মামনুন ইমন। তিনি ব্যস্ত আছেন ওয়েবসিরিজের কাজে। গত জুলাইয়ে আইরিনের বিপরীতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ‘কাগজ দ্য পেপার’ নামে একটি সিনেমায়। তবে সিনেমাটির কাজ কতদূর তা জানা যায়নি।
সমিতির দফতর ও প্রচার সম্পাদক জ্যাকি আলমগীর সিনেমায় নানা ছোটখাটো চরিত্র কাজ করতেন। যদিও এখন তার হাত প্রায় ফাঁকা। সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক জাকির হোসেন বেশিরভাগ সময় সমিতিতেই সময় কাটান। কোষাধ্যক্ষ ফরহাদের ব্যস্ততা এখন নিজের ব্যবসা নিয়ে। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য আলেক জান্ডার বো। একসময়ের ব্যস্ততম এই অভিনেতার হাতে তেমন সিনেমা নেই। সমিতির একজন জানান, এখন দুটি সিনেমার কাজ করছেন তিনি, তবে সিনেমার নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি। বো’কেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
আলাপকালে জানা যায়, আলীরাজ নিয়মিত বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় সহশিল্পীর ভূমিকায় কাজ করলেও প্রবীণ অভিনেত্রী অঞ্জনা সুলতানার সিনেমাকেন্দ্রিক কোনো ব্যস্ততা নেই। তিনি ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। রোজিনার ব্যস্ততা ছিল অনুদানের ছবি ‘ফিরে দেখা’ পরিচালনা নিয়ে। করোনার কারণে সেটিও স্থগিত হয়ে আছে। অরুণা বিশ্বাসও অনেকটা তাই। অনুদানের সিনেমা ‘অসম্ভব’-এর কাজ শুরু করেছেন, শেষ করতে পারেননি। অন্য সদস্য আসিফ ইকবালের সব ব্যস্ততা ব্যবসা নিয়ে। আর আইটেম গার্ল জেসমিনের কাজের কোনো হদিসই দিতে পারেনি তার সহকর্মীদের কেউ। সমিতির একজন সদস্য জানান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জেসমিন অংশগ্রহণ করেন।
সমিতির সদস্য রাজ্জাকপুত্র বাপ্পারাজের অবস্থান এখন সিনেমা থেকে অনেক দূরে। সিনেমাহীন এই একসময়ের তারকাকে প্রকাশ্যেও দেখা যায় না খুব একটা। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শায়িত আফজাল শরীফ। কাজহীন রয়েছেন আরেক সদস্য মারুফ আকিবও।
সমিতিতে আছেন সিনেমায় নেই- বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিকে নিয়ে প্রায়শই এমন ট্রল ওঠে মিডিয়ায়। তবে সেই অভিমত টপকে পরীমণি ইস্যুতে সমিতির ভাবমূর্তি নামলো আরও একধাপ। সিনেমা শিল্পের বেশিরভাগই বলছেন, শিল্পীদের স্বার্থ রক্ষা নয়, বিকিয়ে দেওয়াই সমিতির কাজ!
সম্প্রতি যার প্রতিধ্বনি মিলেছে জ্যেষ্ঠ শিল্পী উজ্জ্বল, আলমগীর ও ইলিয়াস কাঞ্চনদের কণ্ঠস্বরেও। সমিতির নেতারা বরাবরই দাবি করেন, এই জ্যেষ্ঠদের পরামর্শেই নাকি পরিচালিত হচ্ছেন তারা। সর্বশেষ ৭ আগস্ট পরীমণির সদস্যপদ স্থগিত করা প্রসঙ্গে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান দাবি করেন, এটা তার একক সিদ্ধান্ত নয়। এতে যুক্ত আছেন জ্যেষ্ঠ শিল্পী আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, সোহেল রানাসহ সবাই!
সেদিন ‘ব্রিটল বিস্কুট’-খ্যাত এই সাধারণ সম্পাদক আরও বলেছিলেন, ‘শিল্পী সমিতির সিদ্ধান্ত জায়েদ খান একা নেন না। মিশা সওদাগরও না। পরীমণির বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা কমিটির ২১ জন সদস্যের। এমনকি আমরা আমাদের সিনিয়র শিল্পী আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, উজ্জ্বল, সোহেল রানাসহ সবার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি’।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায় উল্টো কথা। বরং সিনিয়রদের নাম ব্যবহার করে অসত্য তথ্য দিয়েছেন তিনি। সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ শিল্পীর মতের প্রতিফলন হয়নি। এমনকি নায়ক আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগই করেনি সমিতির কেউ।
সমিতির কার্যক্রমে বিব্রত জ্যেষ্ঠ শিল্পীরাও
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আলমগীর বলেন, ‌‘এটা সাম সর্ট অব সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করা হয়েছে। তারা যোগাযোগ না করে আমার নাম ব্যবহার করেছে’।
অন্যদিকে কথা বলে জানা গেছে, পরীমণির সদস্যপদ নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন ও উজ্জ্বল যে মত দিয়েছিলেন তা অগ্রাহ্য করেছে সমিতি। তাদের পরামর্শ ছিল, পরীমণির সদস্যপদ স্থগিত করাটা এখনই জরুরি নয়, সবকিছু দেখে-শুনে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
তার মানে, এই সমিতির নেতারা যেমন সিনেমায় নেই, তেমনি শিল্পীদের স্বার্থে বা সঙ্গেও নেই! প্রশ্ন- আছেন কোথায়? সূত্র- বাংলাট্রিবিউন

ডিসি/এসআইকে/এমএকে