ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বে উদাহরণ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক : যে কোনো ধরণের ঝুঁকি মোকাবেলায় বেশ সাহসিকতার সাথেই অনুকরণীয় ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করে, তৃণমূল থেকে সংগৃহীত তথ্য বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শেষে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কৌশলী প্রয়োগের মাধ্যমে এই সফলতা অর্জন করছে। এতে মূল ভূমিকা রাখছে আইনশঙ্খলা বাহিনীগুলোর সাথে তৃণমূল মানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়টি। অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে তৃণমূল সাধারণ মানুষের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর নিবিড় একটি সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। বাহিনীগুলোর নানান উদ্যোগ, জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মকান্ড, সংবাদমাধ্যমগুলোতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, আলোচিত সব ঘটনাগুলোর রহস্য, তদন্ত আর দ্রুততার সাথে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করানোর প্রবণতাই এই সফলতার অন্যতম ক্রীড়ানক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু অপরাধের অভিযোগ থাকলেও সফলতার কাছে এসব অভিযোগ ততোটা আলোচিত না হলেও নানান কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগটি পূরনো। এতোসবের পরেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশ এবং এই বাহিনীর স্বতন্ত্র ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাম্প্রতিক সফলতাগুলো সকল কিছুকেই ম্লান করেছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, পুলিশের কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম, এই ইউনিটের মাধ্যমে নিয়মিত এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কর্মকান্ড, নিয়মিত ওপেন হাউজ ডে আয়োজন, মসজিদ, মন্দির, পেগোডা আর চার্চে সরাসরি উপস্থিত হয়ে পুলিশের ফাঁড়ি, থানা, জোন, সদর- এভাবে প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি, হ্যালো ওসি, নিয়মিত মতবিনিময়, পর্যায়ক্রমে সরাসরি একান্তে থানার ঊর্ধ্বতন এবং সাধারণ মানুষের ইচ্ছানুসারে এসি, ডিসি, কমিশনার, এআইজি, আইজি পর্যন্ত সরাসরি কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অপরাধ দমন অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানান সফলতার কারণে আস্থার জায়গায় নিতে পারছেন বলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সফল হতে পারছে।

এই সফলতার পেছনের সূত্রগুলো বাহিনীগুলোর কর্তাব্যক্তিরা প্রকাশ না করতে চাইলেও বিভিন্ন সূত্র ও বাস্তবিক গবেষণা করে এই সফলতার পেছনের কিছু কৌশল সম্পর্কে জানা যায়। সূত্র বলছে, তৃণমূল থেকে অপরাধ ও অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে পর্যায়ক্রমে তা  দ্রুত সদর দফতরে পাঠানো হয়। ওইসব তথ্য ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখায় নথিভুক্ত করার পর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা ইউনিটগুলোতো আছেই, অন্যান্য মাধ্যমেও অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশিং ব্যবস্থা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও ভার্চুয়াল জগতের অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে থাকে পুলিশ।যুদ্ধাপরাধী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও পলাতক আসামিদের তথ্য কিভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখার কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। বিষয়টি গোপনীয় উল্লেখ করে এ বিষয়ে তথ্য দিতেও রাজি হননি তারা। তবে কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, সোর্স কিংবা গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সেই তথ্য সংগ্রহেও নতুনভাবে এগুচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও যেসব অ্যাপে মানুষ যোগাযোগ করে থাকে, সেগুলোতেও নজরদারি করা হয়। কারণ, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা এখন ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমেই নিজেদের মধ্যে বেশি যোগাযোগ করে থাকে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) অপরাধ সংঘটনে প্রযুক্তির অপব্যবহার প্রতিরোধে কাজ করছে। এরমাধ্যমেও জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের তথ্য পেয়ে থাকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।

পুলিশ সদর দফতরের কমিউনিটি পুলিশিং শাখার এআইজি সহেলী ফেরদৌস বলেন, ‘অপরাধীর তথ্য সংগ্রহে পুলিশের প্রধান সোর্স হয়ে উঠেছে কমিউনিটি পুলিশিং। কারণ, আমাদের এই কমিউনিটির মধ্যেই যেহেতু অপরাধীরা থাকে, তাই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্যরা অপরাধীদের খবরটা আগে পান। তখন তাদের কাজ হচ্ছে থানা পুলিশকে অবগত করানো যে, এখানে এ ধরনের অপরাধী আছে, কিংবা অপরাধের আলামত দেখা যাচ্ছে। এরপর পুলিশ তাৎক্ষণিক সেই অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে। ভবিষ্যতের জন্য আরও কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে ও এলাকায় ৮-১০ জনের টিম করে রাতে পাহারা ও সোর্স নিয়োগের মাধ্যমে অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় গোড়ামী নিয়ে কেউ অপব্যাখ্যা করছেন কিনা, বিতর্কিত ফতোয়া, হিল্লা ও বাল্য বিয়েসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও চোরাচালানি, মানব পাচারকারী, খাদ্যে ভেজালকারী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টিতে কাজ করবে কমিউনিটি পুলিশিং।

একই উদ্দেশ্যে নিজ উদ্যোগে পুলিশের সিলেট রেঞ্জে বছর দু’য়েক আগে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন ডিআইজি কামরুল আহসান। যে কারণে গত পুলিশ সপ্তাহে তাকে পদকও দেওয়া হয়েছিল। কামরুল আহসান বলেন, ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের এই যুগে বাংলাদেশে যেন তৃণমূলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দানা বেঁধে উঠতে না পারে, সেজন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সদর দফতরের অনুমতি নিয়েই সেসব উদ্যোগকে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য এলাকাভিত্তিক আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শুধু সিলেট অঞ্চলেই নয়, সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন’।

কামরুল আহসান জানান, বিট পুলিশিংয়ের ধারণাটা প্রথমে ছিল শহরকেন্দ্রিক। পরে পিআরবি প্রবিধান ৬৫৬ অনুযায়ী সিলেট অঞ্চলের সব জেলা ও পৌর শহর, ইউনিয়নের ওয়ার্ড-ভিত্তিক বিট পুলিশিং গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে বিট পুলিশিংয়ের আওতায় প্রতিটি গ্রাম ও মহল্লাকেও নিয়ে আসা হয়। এর ব্যাপক সুফল পাওয়া যায়। পরে এ পদ্ধতি গ্রহণ করেন অন্যান্য এলাকার পুলিশ কর্মকর্তারাও।বিট পুলিশিংয়ের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তার এলাকার ম্যাপ তৈরির জন্য। এরপর তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় বিটের আওতাধীন জিআর ও সিআর মামলা এবং ওয়ারেন্ট ও সাজার তালিকা তৈরি, বিভিন্ন পেশার কমপক্ষে ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিটের আওতাধীন শীর্ষ ১০ সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি করার জন্য। এছাড়াও এলাকার ভাড়াটিয়াদের তালিকা, কেয়ারটেকারের তত্ত্বাবধানে থাকা বাসা বাড়ির তথ্য সংগ্রহ, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দিরের প্রধানদের তালিকা করা। বহিরাগত লোকদের তথ্যসহ এলাকার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অগ্রিম গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, ‘এভাবেই সারাদেশ থেকে এখন অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য সংগ্রহ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে’।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সতন্ত্র সংস্থা হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। সংস্থাটির প্রধান হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্য প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে অপরাধ কার্যক্রমে প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। এনটিএমসির প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে সন্ত্রাসীদের তথ্য ও প্রযুক্তিগত সব সহায়তা দিচ্ছে থাকে এনটিএমসি।

তবে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শত সফলতা থাকলেও একটি মাত্র অঘটন পুরো সফলতাকে ম্লান করে দেয়। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, অপরাধের তথ্য রয়েছে, সেই সদস্যদের বিরুদ্ধে বাহিনীর নিজস্ব নীতিমালার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে একটি জাতির আস্থার প্রতীকে পরিণত হতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। যেসব সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে নানান অভিযোগ আনা হয়েছে এবং প্রমাণিত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য শাস্তি প্রয়োগ করলে বাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে।

গত কয়েক বছরে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত্বপনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সফলতার প্রশংসা দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের এই বাহিনীগুলোর সফলতাগুলো বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকান্ড সরেজমিনে পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা অর্জনে অনেক দেশ বাংলাদেশের দ্বারস্থ হচ্ছে। যদি রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তি ক্ষমতার প্রভাব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর উপর না চাপানো হয়, তাহলে হয়তো অচিরেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বিশ্বের অনুকরণীয় বাহিনীতে পরিণত হবে।