প্রায় ২ মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে তারা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
শুরুটা হয়েছিল ফসলী জমিতে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে।  গত ৩১ অক্টোবর দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আশুড়ার বিলে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে অনশন কর্মসূচি শুরু করেছিলেন ২৫টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা।  এই অনশনের ১১১ দিন অতিবাহিত হয়েছে।  যে জমিতে ফসল ফলানোর দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন এসব কৃষক পরিবার, সেই জমিতে তারা রোপণ করেছেন বোরো ধানের চারা।  চারাগুলোও বেশ তরতাজা হয়ে পুরো মাঠে এখন সবুজের সমারোহ।  কিন্তু এরপরও কৃষকরা ফিরে যেতে পারেননি নিজ বাড়িতে।  যে কোনও সময় ওইসব ধানের চারা নষ্ট করে সেখানে বাঁধ নির্মাণ হতে পারে এমন আশঙ্কায় কৃষক পরিবারের সদস্যরা পালা করে রাতের বেলায় পাহারা দিচ্ছেন ফসল।  আর দিনের বেলায় সেই অনশন কর্মসূচিতেও থাকছেন অনেকেই।
চলমান অনশনের মধ্যেই খোলা আকাশের নিচে সময় পার হচ্ছে এসব পরিবারের।  তারা জানিয়েছেন, গত বছরে বাঁধ দেওয়ার কারণে তারা আবাদ করতে পারেননি।  তাই একরকম অর্ধাহারে-অনাহারেই কেটেছে তাদের দিনরাত।  গত বর্ষায় পানির প্রবল চাপে এই বাঁধ ভেঙে যায়।  তাই আবারও জলাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন তারা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই জমিগুলোতে আবাদ হচ্ছে।  পূর্ব পুরুষদের ধারাবাহিকতায় বর্তমানের কৃষকরা এই জমিগুলো আবাদ করে আসছেন।  এখানে যেমন বিলের জমি রয়েছে, তেমনিভাবে রয়েছে ব্যক্তিগত মালিকানা জমি।  তাদের দাবি, এখানে প্রায় এক হাজার ৯০০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। সরকারি জমি কেউ লিজ নিয়ে আর কেউ পত্তন নিয়ে আমন, বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে আসছিলেন।  ২০১৯ সালে আশুড়ার বিল এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করে প্রশাসন।  এতে করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে বিলপাড়ের ব্যক্তি মালিকানার জমিগুলোতেও আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। বাঁধটি খুলে দেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানানো হলেও নেওয়া হয়নি কোনও পদক্ষেপ।  অবশেষে ২০২০ সালের প্রবল বর্ষায় পানির চাপে বাঁধটি ভেঙে যায়।  বাঁধ ভেঙে পানি নিষ্কাশিত হয়ে আবারও আবাদের উপযোগী হয় জমিগুলো।  কিন্তু আবারও সেই বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।  বাঁধ মেরামত ও নির্মাণের জন্য এক্সকেভেটর মেশিন নিয়ে আসা হলে স্থানীয় প্রায় ২৫টি গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো সেখানে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে।  ফলে প্রশাসন আর বাঁধ নির্মাণ করতে পারেনি।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় ওইসব জমিগুলোতে বোরো ধানের চারা রোপন করেন স্থানীয় কৃষকরা।  কিন্তু এরপর নানামুখে তারা শুনতে থাকেন, যে কোনও সময়ে ওই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ফলে কৃষকদের মনে আশঙ্কা দেখা দেয়, যদি বাঁধ নির্মাণ হয় তাহলে এই ধানগাছগুলোও পানিতে তলিয়ে যাবে।  ফলে আর ঘরে তোলা হবে না সোনালী ফসল।  তাই স্থানীয় কৃষকরা অনশনের তাঁবুতেই দিন-রাত যাপন শুরু করেন।  পালা করে দিনে ও রাতে দিয়ে আসছেন পাহারা।
নবাবগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থী রাবেয়া সুলতানা বলেন, আমার বাবা কৃষক।  বাঁধ দেওয়া নিয়ে কর্মসূচির কারণে সবাই এখানে। এই অনশনে ব্যস্ত থাকায় কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারছি না।  আমরা এই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প প্রত্যাহারের দাবি করছি।  আরেক শিক্ষার্থী ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাহসিনা মিম বলে, তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আমার বাবা-মা এখানে অবস্থান করছেন।  যদি ধান না হয় তাহলে পড়ালেখা করবো কীভাবে।  আমরা এই বাঁধ চাই না।
স্থানীয় নুর বানু বলেন, আমার স্বামী মারা গেছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে।  আমার চারটি মেয়ে।  তাদের বিয়ে দিতে পারছি না। এর ওপর আবার জমিতে ফসল হচ্ছে না।  সব জমিগুলোই বিলের মধ্যে। খেয়ে-না খেয়েই দিন যাপন করছি।  এবারে ফসল হলে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।
স্থানীয় কৃষক ফয়জার রহমান বলেন,  আমরা এখানে তিন মাসের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছি।  একেক জনে একেক রকমের ক্ষতিগ্রস্ত।  গত মৌসুমে আমরা কোনও ফসল ঘরে তুলতে পারিনি। এক প্রকারের খাদ্য সংকটে আছি।  এখন যেহেতু ধান লাগিয়েছি, তাই ধান যেন ঘরে তুলতে পারি।  আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, যে চিরস্থায়ীভাবে এখানে যেন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হয়।
প্রায় ৭০ বয়সী কৃষক বিল্লাল হোসেন বলেন, আমি সারা জীবনে খেটেখুটে চার বিঘা মাটি ক্রয় করেছি।  এক বছর ধরে এখানে আবাদ নাই।  সরকারের কাছে আবদার যে এখানে আমরা নিজ জমিতে আবাদ করতে চাই।  এইখানে বাঁধ হলে আবাদ হবে না। এক কেজি চাল কিনতে হলে ৫০ টাকা লাগে।  কীভাবে খাবো, পরিবারের আমার চার জন সদস্য।
কৃষক জহুরুল ইসলাম জানান, বন্যায় বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় আমরা এবার ধান আবাদ করেছি।  কিন্তু শুনছি এখানে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।  আমাদের জমির ধান নষ্ট করে দিতে চায়।  তাই আমরা নিজ ফসল রক্ষার জন্য অনশন কর্মসূচির পর এখন দিন-রাত বাঁধ ও ধান পাহারা দিচ্ছি।
অনশন কর্মসূচি শুরুর সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় রেজাউল করিম।  তিনি বলেন, এই বিলে গত বছর বাঁধ দেওয়ার কারণে আমাদের এই ৩০ হাজার পরিবার বিলে আবাদ করতে পারেনি।  তারা অসহায় অবস্থার মধ্যে ও সংকটে পড়ে যায়। করোনাকালীন সময়ে এই সংকট আরও বৃদ্ধি হয়েছে।  আবারও যদি বাঁধ নির্মাণ করা হয় তাহলে ধানগাছগুলো পানিতে ডুবে যাবে এবং আমাদের আরও সংকটে পড়তে হবে।  অনেকেই হুমকি দিচ্ছে যে রাতের আঁধারে এসে এখানে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।  এজন্য তিন মাসেরও অধিক সময় ধরে আমরা এখানে অবস্থান করছি, ধানের চারাগুলো পাহারা দিচ্ছি।  আমাদের প্রধানমন্ত্রী যতদিন না বলছেন যে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়েছে, ততদিন আমরা এখানেই থাকবো।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুন নাহার জানান, ‘বাঁধ নির্মাণের এখনও কার্যাদেশ পাওয়া যায়নি। কার্যাদেশ পেলেই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে’।  লোকজন তাদের ফসল পাহারা দিচ্ছেন বিষয়টি জানা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লোকজন আছেন কি না আমার জানা নাই এবং তারা ফসল পাহারা দিচ্ছেন কি না সেটিও জানি না’। ফসল রক্ষার জন্য প্রশাসনের কোনও পদক্ষেপ আছে কিনা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ জানায়নি’।   এতদিন অনশন কেন চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এতদিন কি কোন অনশন চলে? এতদিন অনশন করলে কি কেউ বাঁচে’?

ডিসি/এসআইকে/এমএস