বীরাঙ্গনা জয়গুনের মুখে ‘ভয়ংকর নির্মমতার’ কথা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে বন্দি হয়ে ‘ভয়ংকর নির্মমতার’ স্বীকার হয়েছিলেন বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার খানম। সেই বীভৎস অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কাঁদছিলেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডির নগর হাসপাতালে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অশ্রুভেজা চোখে একাত্তরে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা তুলে ধরে জয়গুন নাহার বলেন, বাবা আর ভাইদের মারতে মারতে অচেতন করে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পে পাঁচ-ছয় মাস ধরে চারজন পাকসেনা দিন-রাত নির্যাতন চালাত। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল আমার। সুযোগ বুঝে একদিন পালিয়ে আসি সেখান থেকে।
জয়গুন আরও বলেন, যুদ্ধ শেষে ফাল্গুনে জন্ম হয় তার মেয়ে নিমসানার। এরপর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। পরিবার, সমাজের নানা কটু কথা শুনে দিন পার করতে হয় মা ও মেয়েকে। এভাবে ৫০ বছর কেটেছে জয়গুনের। পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা। এখন বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষা করে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। যুদ্ধদিনে জয়গুনের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে উপস্থিত অতিথিরাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার খানমের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, আড়াই লাখ বীরাঙ্গনার হিসাব, নাম, পরিচয় রাষ্ট্রকে দিতে হবে। আড়াই লাখ বীরাঙ্গনার কথা বলা হয়। কিন্তু স্বীকৃতি পেয়েছে মাত্র ৪১৬ জন। এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক আর কী হতে পারে। আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা কেন ৪১৬ জন হলো।
তিনি আরও বলেন, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা, তারা যুদ্ধ করেছি একবার, একাত্তর সালে ৯ মাস। কিন্তু বীরাঙ্গনা যারা আছেন, তারা যুদ্ধ করেছেন বারবার। একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের পর যুদ্ধ করেছেন, এখন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বলা হয়, বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এটা সত্য নয়। ২২ ডিসেম্বর এই উপাধি দিয়েছিলেন সম্ভবত কামারুজ্জামান।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, বীরাঙ্গনাদের অবদান কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশি। আমরা মুজিব শতবর্ষ পালন করছি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, এখন এই বীরাঙ্গনাদের সম্মান দিতে হবে। রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে আড়াই লাখ বীরাঙ্গনার হিসাব, নাম, পরিচয় দিতে।
বীরাঙ্গনা জয়গুন নাহার খানম গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার এখানে বীরাঙ্গনা জয়গুন এতদিন ধরে আছে। কিন্তু আমি অনেক দিন ধরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। কারণ পাকিস্তানিরা তাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, আমরা তার চেয়েও বেশি খারাপ আচরণ করেছি তাদের সঙ্গে। জয়গুন যদি আমাকে বলে আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলাদেশে আমার জন্য কী করেছেন আপনারা। তার সামনে দাঁড়িয়ে তার মতোই দুই ফোটা চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কী করতে পারতাম আমি?
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক বদরুল হক। বক্তব্য দেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার সভানেত্রী ফরিদা আখতার, নারী পক্ষের সদস্য লিপি লিলিয়ান রোজারিও, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এইচ শাহরিয়ার সাবেত প্রমুখ।

ডিসি/এসআইকে/এমএকে