গ্র্যাজুয়েট বেকার তৈরির কারখানা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়…!

বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলার অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা বিবেচনা করা হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে, যা জাতির জন্য বড় বোঝা হয়ে দেখা দিচ্ছে : শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি

মো. ইমতিয়াজ আহমেদ : গ্র্যাজুয়েট (স্নাতক পাস) বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষ শিক্ষক, শিক্ষার মান, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা যাচাই-বাছাই না করেই অর্থের বিনিময়ে উপজেলা ও গ্রামের কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে এসব কলেজ থেকে পাস করে ৭১ শতাংশ বেকার থাকছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এসব বিষয় অবগত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা ভবিষ্যতে যত্রতত্র অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি না দিয়ে যেসব কলেজে অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনার সুপারিশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। 

একাদশ জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ষষ্ঠ সভায় কমিটির সভাপতি মো. আফছারুল আমীন এমপি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপযুক্ত শিক্ষক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে উপজেলা ও মফস্বল এলাকার কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আবার অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর জন্য এমপিওভুক্ত না করার শর্তে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে শিক্ষকরা সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের তদবির ও আন্দোলন করেন। ভবিষ্যতে যত্রতত্র অনার্স কোর্স খোলার অনুমতি না দিয়ে যেসব কলেজে অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। 

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি এমপি

সভায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলার অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা বিবেচনা করা হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে, যা জাতির জন্য বড় বোঝা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফলে বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা দরকার’। 

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, দুই হাজার ৩০০ কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। প্রতি বছর অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি স্কুল-কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে স্কুল-কলেজ সরকারি করার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা নেই। এ সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সম্ভাব্য সরকারিকরণের তালিকায় থাকায় কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স খোলার হিড়িক পড়ে। শিক্ষার পরিবেশ না থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগসাজশে দ্রুত অনার্স খুলে কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে চার-পাঁচজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কয়েক কোটি টাকা নিয়োগ বাণিজ্য করেছে শত শত কলেজ। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নামসর্বস্ব ও অবৈধ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তারা। এসব কলেজে নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় ভর্তি হয়ে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। 

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাব মতে, সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি, যা মোট উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর ৬৮ শতাংশ। প্রতি বছর শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন ৫০ হাজারের বেশি। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের ওপর জরিপ চালিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে কর্মসংস্থানের প্রস্তুতি ও কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি এ চিত্রকে তারা উদ্বেগজনকও বলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পড়ালেখা শেষ করে তিন বছর ধরে চাকরির সন্ধান করতে হচ্ছে ৪৬ শতাংশ কলেজ গ্র্যাজুয়েটকে। তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭১ শতাংশ। কলেজ গ্র্যাজুয়েট পুরুষদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। নারীদের এ হার ৭৭ শতাংশ। মানবিক বিভাগের ৭৪ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ৭১ শতাংশ, বিজ্ঞান বিভাগের ৬৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ৬৯ শতাংশ কলেজ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকছেন। শহর-গ্রামভেদে এ হারে পার্থক্য রয়েছে। মেট্রোপলিটন এলাকার কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৫ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলে ৭২ শতাংশ। 

শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষক সংকট, মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ ও চাকরির বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিকুলাম ঠিক করতে ব্যর্থ হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির বাজার প্রস্তুত না থাকার কারণেও চাকরি পেতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন। 

প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ বলেন, সরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি না দিলে, সেখানে শিক্ষক পদায়ন করা হয় না বিধায় অনেক সময় মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যেসব কাগজপত্র  শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করা হয়, বাস্তবে তা করা হয় না বলে সংসদীয় কমিটির সভায় তিনি জানিয়েছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরে তারা ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতো। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতো না তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সবার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম শুরু করছে। তাতে মেধাবীরাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ না পাওয়ার আশঙ্কায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হচ্ছে। অনেকে ভর্তি হওয়ার পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে চলে যাচ্ছেন। এতে কম মেধাবীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছেন। আর ভর্তি বাতিল করতে শিক্ষার্থীদের প্রায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হচ্ছে।

ডা. মো. আফছারুল আমীন এমপি

এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আফছারুল আমীন এমপি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে চলে যান। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক আসন শূন্য থাকে। শিক্ষার্থীরা দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। এ ভর্তি প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে শিক্ষা কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু করার কারণেই আড়াই থেকে তিন বছরের সেশনজট থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে।