‘অবসর’ প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনকে কি বার্তা দিলো সরকার?

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মকবুল হোসেনের পর পুলিশের এসপি (পুলিশ সুপার) পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেক আগে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠানোর ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
কী কারণে তাদের অবসর দেওয়া হচ্ছে- সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে কিছু জানানো হচ্ছে না। তবে এসব ক্ষেত্রে আইন ও বিধি-বিধান মেনেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে- বলছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী।
সরকারের আস্থাভাজন না হলে কোনো কর্মকর্তা সচিব বা এসপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন না। অন্যদিকে যেখানে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কর্মকর্তাদের লঘুদণ্ড হয়, এমনকি পরবর্তীসময়ে সেসব লঘুদণ্ডও বাতিল হতে দেখা যায়, সেখানে সচিবের মতো একটি মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক নির্বাহী কিংবা এসপির মতো পদ থেকে একেবারে বিদায় করে দেওয়ার বিষয়গুলো সবাইকে অবাক করেছে।
তবে চাকরির মেয়াদ থাকতে কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠানোর নেপথ্য কারণ হিসেবে আলোচনায় আসছে নানা বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সরকারের ওপর যাদের আস্থা নেই কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে যারা ঝুঁকছেন তাদের প্রতি এটা সরকারের কঠোর বার্তা।
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে গত রবিবার (১৬ অক্টোবর) অবসরে পাঠায় সরকার। স্বাভাবিকভাবে আগামি বছরের (২০২৩) ২৫ অক্টোবর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল মকবুল হোসেনের।
এরপর মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। তাদের অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
তাদের সবাইকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
আইনের ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বৎসর পূর্ণ হইবার পর যে কোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করিলে কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া তাহাকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে’।
তথ্য সচিবকে অবসরে পাঠানোর পর তথ্যমন্ত্রী কিংবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে থেকে কোনো কারণ জানানো হয়নি। তবে এ ঘটনার পর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। কেউ কেউ আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যান।
বলা হচ্ছে, আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। যাদের কর্মকাণ্ড অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে, তাদের আর আস্থায় নিতে চাইছে না সরকার।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এ পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক সচিব বদিউর রহমান বলেন, অবসরে পাঠানো নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ের কোনো কারণ নেই। নতুন আইন হওয়ার আগে ১৯৭৪ সালের অবসর আইন অনুযায়ী সরকার কোনো কর্মকর্তাকে ২৫ বছর পর অবসরে পাঠাতে পারতো। আমি এটার বিরুদ্ধে আগে থেকেই বলে আসছি।
তিনি বলেন, উভয়পক্ষের জন্য সম-অধিকার থাকলেও সরকার হলো সার্বভৌম, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে সরকার। সরকার প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম ও রাষ্ট্রের প্রতিভূ। সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে অতীব ক্ষুদ্র ও নগণ্য। ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার জন্য হয়তো চাকরি ছেড়ে দিতে পারে, কোনো অসুবিধা নেই। তবে রাষ্ট্র চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার বিষয়টি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের লক্ষণ নয়। রাষ্ট্রের সেটা করা উচিত নয়। যদি কেউ অন্যায়-দুর্নীতি করে, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে তবে তাকে বিধিমালায় শাস্তি দেওয়া যায়। তারপরও ১৯৭৪ সালের বিধান সরকারি চাকরি আইনে রাখা আছে। কারণ, অনেক সময় বিভাগীয় মামলা করলে অভিযোগ প্রমাণ করা কষ্টকর হয়ে যায়। সময় ক্ষেপণ হয়। এটার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে সরকার হেরে যায়। এজন্য সরকার হাতে ইস্কাপনের টেক্কা হিসেবে এটা রাখে। তবে আইনি ভিত্তিতে আপনি এটাকে বেআইনি বলতে পারবেন না। কিন্তু সংবিধানের ভিত্তিতে এটা কল্যাণমূলক আইন নয়। আমি এটাকে কালা-কানুন বলি।
ভোটের এক বছর আগে কর্মকর্তাদের এ ধরনের অবসরে পাঠানোর কী কারণ, জানতে চাইলে বদিউর রহমান বলেন, অনেকদিন বন্ধ ছিলো, শেষ মুহূর্তে আসবে না কেন? জনতার মঞ্চ কখন হয়েছিল? বিএনপি যাদের আওয়ামী মনা বলে চাকরিচ্যুত করেছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের জামাই আদরে সচিব বানিয়ে দিয়েছে। সচিব হয়েই তারা অবসরে গেছে। রাজনৈতিক দল যদি পচে যায়, রাজনৈতিক দল যদি সিভিল সার্ভিসকে নিরপেক্ষ না রাখে তাহলে এগুলো ঘটবে।
বদিউর রহমান আরও বলেন, সরকার হয়তো এর মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের দুষ্টু মানুষকে বার্তা দিচ্ছে যে, ‘সাবধান- যদি এদিক-সেদিক করো ২৫ বছরের পর খতম করে দেবো। আইন অনুযায়ী এটা হয়েছে বলে এর বিরুদ্ধে কিছু বলাও যাবে না। এখন সিভিল সার্ভিস নেই। জনতার মঞ্চ করে যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হলো তখন আওয়ামী লীগ খুশি। এখন সিভিল সার্ভিসে নেতৃত্বে দেওয়ার মতো কেউ নেই- বলেন এ সাবেক সচিব।
বলা হচ্ছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সচিবের বিরুদ্ধে। সেই দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ রয়েছে সরকারের হাতে। তাই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিএনপি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তিনি কয়েক মাস আগে লন্ডনে গিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত।
গত সোমবার (১৭ অক্টোবর) সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিষয়টির (সচিবের অবসর) অন্তর্নিহিত কী কারণ সেটা আমি জানি না। অন্তর্নিহিত কারণ বলতে পারবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কারণ ছাড়া তো এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয় না। কারণ নিশ্চয়ই আছে।
অন্যদিকে তিন এসপির বিরুদ্ধে কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা হাজিরা দিয়ে চলে যান। ফেসবুকে ভুয়া সংবাদ আদান-প্রদান করেন।
একজন সচিবের পর তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে সরকার মূলত কী বার্তা দিচ্ছে- বুধবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, কোনো বার্তার প্রশ্ন নেই। এটা রুটিন ওয়ার্ক। সার্ভিস রুলেই আছে, চাকরির বয়স ২৫ বছর হলে যে কোনো সময় যে কোনো কর্মকর্তাকে সরকার অবসরে পাঠাতে পারে। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে মনে হয়েছে, হয়তো তাদের কাছে কোনো তথ্য আছে, তাদের (অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের) সার্ভিস হয়তো সন্তোষজনক নয়, সেজন্য তারা (অবসরে) পাঠিয়েছে। খবরসূত্র- জাগোনিউজ

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ