চিত্রনায়ক ফারুকের চিরবিদায়

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
গত জন্মদিনেও বিদেশের হাসপাতাল থেকে ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, দেশের মানুষই তার ভালোবাসার জায়গা দখল করে আছে, সেইসব মানুষদের কাছে শিগগিরই ফিরবেন তিনি। চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের সেই ফেরা আর হল না।
কয়েক বছর ধরে নানা রোগব্যধিতে ভুগে অবশেষে চলে গেলেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ ফারুক।
ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ জানান, সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রক্তে সংক্রমণজনিত জটিলতা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন ফারুক।
শরৎ জানিয়েছেন, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তার বাবার মৃতদেহ মঙ্গলবার দেশের আনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২০২১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল তাকে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরপর থেকে হাসপাতালেই ছিলেন তিনি।
এদিকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে বাবার কবরের পাশে শায়িত হবেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক।
উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের সোমটিওরী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে ফারুকের ভগ্নিপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান খান জানান।
সোমবার বিকালে মফিজুর রহমান খান জানান, ফারুকের স্ত্রী ফারজানা পাঠান, মেয়ে ফারিহা তাবাসসুম পাঠান, ছেলে রওশন হোসেনসহ সকল আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জীবিত অবস্থায় ফারুক সবাইকে বলে গেছেন, মৃত্যুর পর তাকে যেন তার বাবা আজগার হোসেন পাঠানের কবরের পাশে শায়িত করা হয়।
মফিজুর রহমান আরও জানান, সংসদ সদস্য ফারুকের প্রথম নামাজে জানাযা সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে ইউএস বাংলার ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মরদেহ আসার কথা রয়েছে। পরে মরদেহ রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। বেলা ১১ টায় জাতীয় শহীদ মিনার সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য নেওয়া হবে। বাদ যোহর এফডিসিতে দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে।
বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে তৃতীয় জানাযা এবং সন্ধ্যা ৭টায় তুমলিয়া দক্ষিণ সোম গ্রামে নিজ বাড়িতে চতুর্থ জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে সোমটিওরী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে শায়িত হবেন ফারুক।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাদা-কালো পর্দা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনায় উজ্জ্বলএকটি নাম ‘ফারুক’। অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি সিনেমায়।
১৯৪৮ সালের ১৮ অগাস্ট পুরান ঢাকায় তার জন্ম। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু, বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। পাঠান পরিবারের এই সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ছাত্রবয়সেই জড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ধরছিলেন অস্ত্রও।
তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন এই নায়ক, ‘জলছবি’ নামের সেই সিনেমা মুক্তি পায় একাত্তরে। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। যে জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ নামে।
ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ করের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা।
ফারুক-কবরী, ফারুক-ববিতা জুটি সময়ে সাথে সাথে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় দর্শক মনে। বিশেষ করে ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।
এছাড়া শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনাও ফারুকের নায়িকা হয়েছেন বিভিন্ন সিনেমায়।
মুক্তিযুদ্ধের দুই সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং আলোর মিছিল’-এ ফারুক মূল ভূমিকায় না থাকলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুটি কাজকে তার টার্নিং পয়েন্ট ধরা হয়।
গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন। করেছেন বাণিজ্যিক সিনেসাও, এবং সেগুলো সফলও হয়েছিল।
তবে কবরীকে নায়িকা করে ‘সাংরেং বউ’, আর ‘সুজনসখী’ সিনেমা ফারুকের ক্যারিয়ের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়।
‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। এছাড়া চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে এই অভিনেতাকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা।
সিনেমায় আসার আগে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। অসংখ্য মামলায় ব্যাপক পুলিশি হয়রানিরে শিকার হন সেসময়।
উনসত্তরের গণ আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন।
অভিনয় থেকে অবসরের পর রাজনীতির মাঠে শোনা যায় ফারুকে নাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ঢাকা-১৭ আসনের এমপি হন তিনি।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আকবর হোসেন পাঠান ফরুককে পরিচয় করিয়ে দেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা
ফারুকের অসুস্থতা
কোভিড মহামারীর প্রথম বছর ২০২০ সালে খবর আসে জ্বরে ভুগছেন ফারুক। ওই বছরের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপালে ভর্তি থাকতে হয় তাকে।
দফায় দফায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েও রোগ নির্ণয় না হওয়া তার স্ত্রী ফারহানা ফারুক ও ছেলে শরৎ চাইছিলেন তাকে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিতে। কারণ সেখানেই বছর ব্ছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত তার।
ফারহানা ফারুক বলেছিলেন, “সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তার চিকিৎসার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমতি পেলে আমরা তাকে সিঙ্গাপুরে নেবো”।
এরপর পরের বছর ২০২১ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। তখন রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন।
সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর প্রায় চার মাস ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল ফারুককে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মাস ছয়েক আগে পরে তাকে কেবিনে নেওয়া হয়।
এরমধ্যে মাঝেমধ্যে তার শারীরিক অবস্থা ভালো-মন্দ হয়েছে। তার মধ্যেই্ গত ১৮ আগস্টে ৭৪তম জন্মবার্ষিকী এক ভিডিওবার্তায় দেশবাসীর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন এই অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক ও রাজনীতিবিদ।
এরপরে সিঙ্গাপুরেই তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে চলে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার হরফে নাম লেখানো এই নায়ক।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ