সাংবাদিকতা এতো সহজ?

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, এ পেশার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে অধিকাংশ সচেতন মানুষের।  কিন্তু সাংবাদিকতা পেশায় যেমন রয়েছে ঝুঁকি, তেমন রয়েছে সম্মান ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।  এছাড়া সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবেও স্বীকৃত। একজন সৎ নির্ভিক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক সমাজের কাছে যেমন সমাদৃত, তেমনি দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, চোরাচালান, মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ী ও সমাজ বিরোধীদের কাছে আতঙ্ক।  
অপসাংবাদিকতা বাদ দিলে যেটুকু থাকে তার সবটুকুই আত্মতৃপ্তি পাওয়ার জন্য একটি স্বাধীন পেশা সাংবাদিকতা।  এজন্যই সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ আর সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলে আখ্যায়িত করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাইলেই যে কেউ হতে পারে অললাইন মিডিয়ার ‘মালিক’, ‘সম্পাদক’, ‘সাংবাদিক’, ‘ক্রাইম রিপোর্টার’।  এরপর খুলে বসছে প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ফোরামসহ নানান ভূঁইফোর সংগঠন।  এরা দেশের সুপরিচিত টিভি চ্যানেল, জনপ্রিয় পত্রিকার নামে সাইট তৈরি করে তাদের পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করছে বলেও দেখা যায়।  অনেকেকে আবার পুলিশ বা বিভিন্ন সংস্থার সোর্স হিসেবেও কাজ করতে দেখা গেছে যারা নিজেদের সাংবাদিকই পরিচয় দেন।
অন্যদিকে, ‘মানবাধিকার সাংবাদিক’ পরিচয়ে প্রতারণা চলছে দেশজুড়ে।  মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রতারণার অভিযোগ আগে থেকেই আলোচিত।  এসব সংগঠন ঢাকাসহ সারা দেশে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই মুড়ির মোয়ার মতো খুলে বসেছে এসব প্রতিষ্ঠান।  সাংবাদিকতার নামে করছে নিয়োগ বাণিজ্য।  এছাড়াও তাদের নিত্য দিনের কাজ হলো, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘পজেটিভ নিউজ করে দেব’ বলে টাকা নেয়া।  টাকা না দিলে নেগেটিভ নিউজ করার ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া।
তথ্য-প্রযুক্তিবীদরা মনে করেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে ঘরে বসেই একটি সংবাদমাধ্যম খুলছে।  কোনো খরচ ছাড়াই সামান্য প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ফেসবুক টিভি কিংবা ইউটিউব চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল সম্পাদক তারা।  এই সুযোগে অপরাধী ও ধান্দাবাজরা হয়ে যাচ্ছে সাংবাদিক।  যদিও ফেসবুক-ইউটিউব গণমাধ্যম নয় বলে ইতোমধ্যে তথ্যমন্ত্রী পরিস্কার করেছেন।
সম্প্রতি, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকটি ঘটনায় অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পরতেই নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছেন।  ঢাকা-চট্টগ্রামসহ একাধিক জেলায় বেশ কয়েকটি ভুয়া সাংবাদিকদের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, বুমসহ আটক করে পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর জানা গেল তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশক।  সে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করে আলোচনার শীর্ষে।  তার বিরুদ্ধে বেড়িয়ে শতাধিক প্রতারণার তথ্য এবং মামলার সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতের ঘর।
গেলো সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শিশু অপহরণের দায়ে লুপা তালুকদার নামের এক নারী ধরা পড়ার পর জানা গেল তিনিও সাংবাদিক।  একটি অনলাইন টিভির মালিকও না কি সে।  এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে রাজধানী থেকে আটক করে কয়েকজন প্রতারককে।  যারা অনলাইন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খুলে নিয়োগ বাণিজ্য করে আসছে।

চট্টগ্রামে আটক ভুয়া সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। ফাইলছবি

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে পাওয়া ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দিয়ে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা সম্প্রতি সারা দেশেই ব্যাপক হারে বেড়েছে।  বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকরা।  ব্যক্তিগত গাড়িতে ‘‌প্রেস’, ‘সাংবাদিক’ কিংবা অনলাইন পোর্টালের লোগো লাগিয়ে বীরদর্পেই চলে তারা।  অনেকে গাড়ির নাম্বার প্লেটের স্থলে সাঁটানো থাকে প্রেস বা সাংবাদিক কথা।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবাদিকতার নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার তাগিদ জানায়।  এ জন্য গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
চট্টগ্রামের সংবাদকর্মী ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম খান জানান, এতোটা অধঃপতন হয়েছে যে, নিজেকে সংবাদকর্মী পরিচয় দিতে ভয় লাগে, লজ্জাও লাগে।  তিনি বলেন, আমি চট্টগ্রামের একটি প্রথমসারির দৈনিকে (দৈনিক পূর্বদেশ) কাজ করি।  এখন পর্যন্ত বেশকিছু স্বনামধন্য টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে কাজ করেছি।  এই পেশায় আমার বয়স প্রায় ২১ বছর।  কখনো, একটিবারের জন্যও আমার মোটরবাইকে প্রেস কিংবা সাংবাদিক বা আমার প্রতিষ্ঠানের লোগো সম্বলিত কিছু সাঁটাইনি।  কোথাও গাড়ি থামিয়ে পুলিশ চেক করতে চাইলে কাগজপত্র দেখিয়ে দেই।  কিন্তু একবারের জন্যও (না জানতে চাইলে) আমি সাংবাদিক- এই তথ্যটি প্রকাশ করিনা।  কারণ ছোট একটি সমস্যা থেকে উদ্ধার পেতে, কিংবা মাত্র কয়েকশ টাকা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি আমার পেশাকে বিক্রি করতে পারি না- এটাই আমার প্রতীজ্ঞা।  কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বাক্য গঠন করতে পারে না- এমন ব্যক্তিরা গাড়িতে, বাইকে সাংবাদিক সাঁটিয়ে দিব্যি চষে বেড়ান।  তারা নানান কাজে শুপারিশ-ধান্দাবাজির দালালি করেন।  আবার কাউকে কাউকে সাংবাদিক নেতা হতেও দেখেছি যারা সংবাদই তৈরি করতে জানেন না।
সমাজে ‘সাংবাদিক’-এর গ্রহণযোগ্যতা বা বিভিন্ন স্থানে সহজ প্রবেশাধিকারে, রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায়, অপরাধ ধামাচাপা দেয়া ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ‘সাংবাদিক’ পরিচয় ব্যবহার করছে অপরাধীরা।  ঢাকা থেকে প্রকাশিত কিছু ভুঁইফোড় সংবাদপত্র সারা দেশে প্রতিনিধি নিয়োগ করার নামে কার্ড বিক্রি করে এই অপতৎপরতার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিল আগে থেকেই।  এই তালিকায় কিছু বেসরকারি টেলিভিশনও রয়েছে।  চট্টগ্রামেও এই সংখ্যা আশঙ্কাজিনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এক ধরনের অনলাইন পোর্টাল দীর্ঘদিন ধরে অপসাংবাদিকতার কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে।  বিভিন্নজনের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে অনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।  এদের বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতি, গুজব ছড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে।  অনলাইন পোর্টালগুলোর অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন, এগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন।  অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য সরকারের উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানান, এ দেশে প্রতারণা করে সহজে পার পাওয়া যায়। এ কারণে সাংবাদিকতার নামেও প্রতারণা বেড়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, এজন্য গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। এদের বিরুদ্ধেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মনে করেন, রাজনৈতিক ও ব্যাবসায়িক ফায়দা লোটার প্রবণতা থেকেই সাংবাদিকতার নাম ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে।  গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে তারা।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ