বিরল রোগে আক্রান্ত কিশোর

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
অনেক সময়ই কারও মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব দেখলে আমরা রাগের মাথায় পশুর সঙ্গে তুলনা করে থাকি। কিন্তু কোনও মানুষের চেহারা যদি বাস্তবেই ‘নেকড়ে’ বা বানরের মতো হয়, তাহলে তা কিন্তু সত্যিই দুর্ভাগ্যের।
বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) তেমনই এক কিশোরের সন্ধান দিয়েছে এনডিটিভি।
ভারতের সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ললিত পতিদার নামে ১৭ বছরের ওই কিশোরের বাস ভারতের মধ্যপ্রদেশের নন্দলেতা গ্রামে। দেখতে যেন মানুষ নয়, অবিকল এক নেকড়ে! ‘ওয়্যার উলফ’ (Werewolf) বা ‘হাইপারট্রাইকোসিস’ (Hypertrichosis) নামের এক বিরল রোগে ভুগছে সে।
মাত্র ৬ বছর বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হয় ললিত। ইতোমধ্যেই কিশোরের বেশ কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এবং ভাইরাল হয়েছে। যাতে দেখা যায়, তার সমস্ত মুখমণ্ডল ও হাত সম্পূর্ণভাবে বাদামী-স্বর্ণালী লোমে ঢাকা। ঠিক যেন নেকড়ে মানব।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, এমন চেহারার কারণে কিশোর ললিতকে তার সহপাঠীদের বেশ উত্যক্ত করে এবং তাদের কামড়ে দিতে পারে ধারণা করে তাকে ভয়ও পায়। এমনকি ললিতকে তারা “বানর মানুষ” বলেও তিরস্কার করে।
সংবাদ মাধ্যমটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিশোরটি তার শরীরে পশুর লোমের মতো দেখতে বেড়ে ওঠা এই অতিরিক্ত লোমগুলো কামিয়ে রাখে। সে বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং বাবাকে তার কৃষিকাজে সাহায্যই করে।
ললিতের কথায়, ‘আমি একটি সাধারণ পরিবার থেকে এসেছি, আমার বাবা একজন কৃষক এবং আমি বর্তমানে উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। একইসঙ্গে আমি আমার বাবাকে তার কৃষিকাজে সাহায্য করি। আমার জন্মের পর থেকেই শরীরে এই চুল ছিল, আমার বাবা-মা বলেন যে, ডাক্তার আমাকে জন্মের সময় শেভ করে দিয়েছিলেন কিন্তু আমি প্রায় ছয় বা সাত বছর বয়স পর্যন্ত এ সম্পর্কে আলাদা কিছু লক্ষ্য করিনি। তখনই আমি প্রথম লক্ষ্য করি যে, লোমগুলো আমার সারা শরীরে বেড়ে উঠছে, কিন্তু আমি এটা সিম্পর্কে কিছুই জানতাম না’।
ললিত বলছিলেন, এই অবস্থার কোনও প্রতিকার নেই এবং তিনি “এটা সঙ্গী করেই বাঁচতে শিখেছেন”। তিনি আরও বলেন, ছোটবেলায় শিশুরা তাকে পাথর নিক্ষেপ করত এবং তারা দাবি করত যে, সে নাকি এক ধরনের কাল্পনিক প্রাণী!
কি ধরণের রোগ এই “ওয়্যার উলফ” বা হাইপারট্রাইকোসিস?
চিকিৎসকদের মতে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের কোনও একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে অত্যধিক অস্বাভাবিক পরিমাণে লোমের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এর ফলে আক্রান্তের শরীর জন্তুদের মত লোমশ হয়ে যায়।
মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন অনুসারে, হাইপারট্রিকোসিসকে পুরুষ বা মহিলাদের শরীরের যে কোনও জায়গায় অতিরিক্ত চুলের বৃদ্ধি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি একটি অত্যন্ত বিরল অবস্থা, যা রোগীদের পরবর্তী জীবনে বিকাশ লাভ করে। চুলের চরম বৃদ্ধির ফলে বিব্রত হতে পারে, যার ফলে মানসিক বোঝা হতে পারে।
এদিকে, ছোট থেকে ললিতের নানাবিধ শারীরিক সমস্যা থাকলেও, এই অস্বাভাবিক লোম বৃদ্ধির লক্ষণ তখনও প্রকাশ পায়নি। কিন্তু ক্রমে শৈশব উত্তীর্ণ হয়ে, যৌবনে পা রাখবার সময়েই তার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অত্যধিক পরিমাণে লোম বৃদ্ধির জন্য তার শরীর ঢেকে যেতে থাকে, চেহারা হতে থাকে বিকৃত।
বলা যায়, দিন দিন নেকড়ের শরীরের মত হয়ে ওঠে তার শরীর। শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে তাকে লড়তে হয়, এমনকি মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধেও। কারণ তার এই ‘পাশবিক’ রূপ, পরিচিত মহলে অসন্তোষের বীজ বপন করে। তাই বন্ধুদের থেকে শারীরিক নিপীড়নও সহ্য করতে হয়েছে তাকে।
চিকিৎসকদের মতে, হাইপারট্রাইকোসিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জন্মগত কারণেই হয়। বংশগত কারণে হওয়ার প্রমাণও যে কম পাওয়া গেছে, তাও নয়। এটি বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা, হাইপারট্রাইকোসিস ল্যানুগিনোসা (Hypertrichosis Lanuginosa), কনজেনিটাল হাইপারট্রাইকোসিস টার্মিনালিস (Congenital Hypertrichosis Terminalis) এবং নেভয়েড হাইপারট্রাইকোসিস (Nevoid Hypertrichosis)।
এছাড়াও হিরসুটিজম (Hirsutism) নামেরও এক শারীরিক সমস্যা মহিলাদের দেহে লক্ষিত হয়, যা অত্যধিক লোম বৃদ্ধির কারণ। সাধারণত স্টেরয়েডের মত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অপুষ্টি, হরমোনের তারতম্যসহ বিভিন্ন কারণেই এই রোগগুলোর শিকার মানুষ হয়ে থাকেন।
আর এই অবস্থাটি এখন পর্যন্ত ৫০ জনের মধ্যে পাওয়া গেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
সেইভাবে এই রোগের কোনো যথাযথ কারণ বা প্রতিকার কিছু সম্পর্কেই বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা বিভিন্ন মাধ্যমেই চলতে পারে। যেমন- নিয়মিত লোম ছেঁটে দেওয়া, বৃদ্ধির আগেই নির্মূল করা, অথবা ‘ওয়্যাকসিং’ বা ‘প্লাকিং’ এর সাহায্য নেওয়া। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লোম বৃদ্ধি হোক অবশ্যই ভালো চিকিৎসক দ্বারা পরামর্শ নিয়ে, তার কথা মত চলতে হবে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ