মিরসরাইয়ে বছরে দুই ডজন আত্মহত্যা

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যা বেড়েছে। গত ছয় বছরে উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় শতাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বছরে যা প্রায় ২ ডজন। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট, অসুস্থতা এসব আত্মহত্যার মূল কারণ। শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সববয়সী মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফেসবুকে ‘ক্ষমা প্রার্থী’ স্ট্যাটাস দিয়ে সন্ধ্যায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন আরিফ হোসেন (২৩) নামের এক ফল ব্যবসায়ী।
গত ২২ আগস্ট উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার জামালপুরে অভাবের তাড়নায় চিরকুট লিখে আমির ইমরান বিশ্বাস (৪৭) নামের এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। ১৮ আগস্ট গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন আলিম উল্লাহ (৩০)। তার বাড়ি উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের চুনিমিঝিরটেক এলাকায়। তিনি মানসিকভাবে হতাশ ছিলেন বলে জানা গেছে।
১২ আগস্ট উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ আলীনগর আবাসন প্রকল্পের রানা প্রকাশ কালা (২২) আত্মহত্যা করেন। ১১ আগস্ট আত্মহত্যা করেন উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামের লাল কর্মকার বাড়ির এক গৃহবধূ। তার আগে ২৬ জুলাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বড়কমলদহ এলাকায় আত্মহত্যা করে সুমাইয়া বিনতে কালাম (১৭) নামের এক কিশোরী। দাখিল পরীক্ষার ফল প্রকাশের দুদিন আগে আত্মহত্যা করে সে।
একই মাসে উপজেলার হাইতকান্দি ইউনিয়নের বালিয়াদি এলাকায় গলায় ফাঁস দিয়ে তানজিনা (১৯) নামের এক কলেজছাত্র আত্মহত্যা করেন। উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের চুনিমিঝিটেক এলাকার পরকীয়ার জেরে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেন নাজিম উদ্দিন সাইফুল (৪২) নামের তিন সন্তানের জনক।
গত ১৯ মে সৌদি আরবে গলায় ফাঁস দিয়ে সাদ্দাম হোসেন (২৯) নামের এক প্রবাসী আত্মহত্যা করেন। উপজেলার জামালপুর এলাকায় কামরুল ইসলাম (২০) সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। মারধরের বিচার না পেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন কৃষ্ণ দেবনাথ (৪০) নামের এক অটোরিকশাচালক।
২০২২ সালের ১৯ জুলাই শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অপমান সইতে না পেরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন রূপনা দাস (৩৩) নামের এক গৃহবধূ। বিয়ের দুই মাস না যেতেই আত্মহত্যা করেন উপজেলার ওসমানপুর এলাকার সোনিয়া আক্তার (১৯)।
আত্মহত্যাকারী অন্যরা হলেন হিঙ্গুলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জামালপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী (২৭), বারইয়ারহাট পৌর বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রণব বণিক (৩৮), মঘাদিয়া ইউনিয়নের ফকিরপাড়ার মোহনা বেগম (১৬), হোটেল শ্রমিক মফিজুল ইসলাম, সাহেরখালী ইউনিয়নের ভোরের বাজারে পাশে ভেলু ড্রাইভার মাইমুনা মাহি (১৯), কাটাছরা ইউনিয়নের পূর্ব কাটাছরা গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া বেগম (৫৫), করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ অলিনগর এলাকার সানজিদা আক্তার শারমিন (১৪), সাহেরখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ মঘাদিয়া ঘোনা এলাকার সাতভাইয়া বাড়ির সেলিনা আক্তার মনি (৩৫), মিঠানালা ইউনিয়নের রহমতাবাদ গ্রামের আহমেদুর রহমান (৮৫) ও ধুম ইউনিয়নের শুক্কুর বারইয়ারহাটের সুলতানা চাঁদনি (১৪)
গণমাধ্যম, হাসপাতাল এবং থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে মিরসরাই উপজেলায় শতাধিক মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ আত্মহত্যা করেছেন পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট ও সম্পর্কে অবনতিসহ নানা কারণে।
আত্মহত্যার এ প্রবণতা উদ্বেগের বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. এএসএম রিদওয়ান।
তিনি বলেন, ‘যেভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে তা সত্যিই শঙ্কার। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে তাদের ছেলেমেয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। নাহলে যে কেউ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে’।
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগংয়ের (ইউএসটিসি) মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শফিউল হাসান বলেন, বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক থেকে কিশোর সব বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। মূলত পরিবেশগত কারণে এটি বেড়েছে। তিনি বলেন, আমরা আগে দেখতাম একান্নবর্তী পরিবারে শিশু-কিশোররা বেড়ে উঠছে। সেখানে শিশুদের মধ্যে উন্নত মনমানসিকতা তৈরি হতো। যা তাদের সুন্দর ভবিষ্যত তৈরিতে সাহায্য করতো। এখন মা-বাবা ছাড়া আর কেউ থাকে না। আবার মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী হলে শিশু-কিশোররা একাকিত্বে ভোগে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তী জীবনে এসব শিশু-কিশোররা সামান্য বিষয়গুলো নিয়ে আত্মহত্যা পথ বেছে নেয়।
এ বিষয়ে মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন বলেন, আমি থানায় যোগদানের পর আত্মহত্যার ঘটনা তুলনামূলক কমেছে। তবে বেশিরভাগ আত্মহত্যা প্রেমঘটিত ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ বা পারিবারিক কলহের কারণে। আর সব আত্মহত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। যেগুলো আমরা খবর পেয়ে থাকি সেগুলোর বিষয়ে অপমৃত্যু মামলা করা হয়।

ডিসি/এসআইকে/এসইউআর