বাঁশখালীতে অ্যাম্বুলেন্সেই দ্বিতীয়বার হামলা ও কুপিয়ে ট্রাকচালককে খুন

বাঁশখালী প্রতিনিধি >>>
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ সাধনপুর এলাকায় পূর্ব শক্রতা ও বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় ট্রাক চালক জহিরুল ইসলাম (৩৫) নামে এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন।  আজ মঙ্গলবার (১২ মে) সকালে সংঘটিত ঘটনায় আরো ৮ জন আহত হয়েছেন।  এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।  পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে গ্রেফতার কিংবা আটক করতে পারেনি।
নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সাধনপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ সাধনপুর আশরাফ আলীর বাড়ি এলাকায় পূর্বের বিরোধের জের ধরে গত সোমবার রাতে দিদারুল আলম ঝুন্টু (৪৫) ও তার ছেলে তানজিব হোসেনের (১৯) উপর হামলা করে প্রতিপক্ষের লোকজন।  এ ঘটনায় আহত তানজিবকে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠিয়ে দিদারুল আলম ও তার ছেলে রবিউল আউয়ালকে নিয়ে বাঁশখালী থানায় অভিযোগ দায়ের করতে আসার খবর পেয়ে প্রতিপক্ষের লোকজন রাতে আবারো হামলা চালায়।  এসময় বাড়িতে থাকা লোকজনকে মারধর, বাড়ির মালামাল ও টাকা পয়সা লুটপাট করার অভিযোগ পাওয়া যায়।  এ ঘটনার জের ধরে আজ মঙ্গলবার (১২ মে) সকালে পুনরায় দলবদ্ধ হয়ে হামলা করে।  হামলায় জহিরুল ইসলাম (৩৫), জামাল (৫০), রবিউল (২০), তানজির (১৯), সাজ্জাদ (১৭) ইশরাতুল জান্নাত (১৫), কাউসার জাহান (১৬) আহত হন।  তাদের মধ্যে গুরুতর আহত জহিরুল ইসলামকে উদ্ধার করে কালীপুর ইউপির গুণাগুরীস্থ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চমেক হাসপাতালে প্রেরণের নির্দেশনা দেন।  চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে চমেক হাসপাতালে আসার পথে উপজেলার গুণাগুরী ভাসাইন্যার দোকান নামক স্থানে স্থানীয় বিএনপির নেতা আবদুল হকের বাড়ির সামনে পৌঁছলে অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে সেখানে আবারো হামলা চালানো হয়।  হামলাকারীরা এসময় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা আহত জহিরুল ইসলামের উপর অমানবিক হামলা চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

নিহত জহিরুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে নিহত জহিরুল ইসলামের ভাইপো রবিউল আউয়াল জানান, দীর্ঘদিন যাবত আমি ও আমার চাচা ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করে আসছি।  গত ৫ মে রাতে গুণাগুরী থেকে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে নুরুল মোস্তফা ও রহিম নামের দু’জন আমার উপর হামলা চালায়।  এসময় তারা আমার সাথে থাকা টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় এবং আমি আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করি।  গতকাল (সোমবার) রাতে বাড়ি ফিরে মামলা করার জন্য থানায় যাওয়ার খবর পেয়ে আবারো বাড়ির সামনে হামলা করে তারা।  এতে আমার ছোট ভাই তানজিব ও বাবা আহত হন।  তানজিবকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে আমি এবং বাবা থানায় গেলে রাতে স্থানীয় জামায়াত নেতা নেজাম উদ্দিন, মনির আহমদ, ইয়াছিন, ইলিয়াস ও বিএনপি নেতা আবদুল হকের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে আবারো হামলা করা হয়। আজ (মঙ্গলবার) সকালে আবারো হামলা চালালে জহিরুল ইসলাম গুরুতর আহত হন। তাকে গুণাগুরী মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে চমেক হাসপাতালে প্রেরণের নির্দেশনা দেন। চমেক হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে আবারো হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই আমার চাচা জহির মৃত্যুবরণ করেন।
অ্যাম্বুলেন্স চালক মোহাম্মদ পারভেজ দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, হামলায় আহত রোগীকে চমেক হাসপাতালে নেয়ার পথে অনেকগুলো মানুষ গাড়ির গতিরোধ করে। তারা আমাকে দা-কিরিচ দিয়ে কোপ দেয়ার ভয় দেখিয়ে গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়। তাদের সবার হাতেই দা-কিরিচসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তখন পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর ছিল যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এসময় গাড়িতে থাকা কয়েকজনকে মারধর করে তারা। মূলত তাদের আচরণে বোঝা যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্সে থাকা আহত ব্যক্তি তাদের টার্গেট ছিল। তারা তাকেও দা-কিরিচ দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এসময় রোগী চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তারা অ্যাম্বুলেন্সের দরজাও ভাঙচুর করে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে কালীপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মাজার গেট এলাকায় বোনের বাড়িতে হামলা চালায় নেজাম প্রকাশ আবুল, মনির আহমদ ও আবদুল হক। তারা স্থানীয় মাহমুদুল ইসলামের ঘর ভেঙে দেয়। খবর পেয়ে সেখানে যান নিকটাত্মীয় টিটুসহ কয়েকজন। সেখানে টিটুর হাতে কিরিচ দিয়ে কোপানো হয়। তাকে রাতেই হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনার খবর পেয়ে নিহত জহিরের প্রতিবেশি ইলিয়াছ ও আহমদুর ঘর থেকে দা-কিরিচ উদ্ধার করে। এ ঘটনার জের ধরে দুইপক্ষের মধ্যে রাতভর উত্তেজনা চলছিল। সকালে পুনরায় সংগঠিত হয়ে জহিরকে তার নিজ বাড়ির উঠানে কিরিচ দিয়ে কোপায় ইলিয়াছ। পরে দ্রুত গুণাগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে চমেক হাসপাতালে নেয়ার পথিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে আবারো হামলা চালিয়ে জহিরের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার রাতের ঘটনায় পুলিশ ব্যবস্থা নিলে পরদিন খুনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না। খুনের সাথে জড়িত ইলিয়াছ, আহমদু, আবদুল হক, মনির আহমদ, নেজাম সবাই মিলে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এলাকায় জায়গা দখল, জায়গা বেচাকেনায় তারা প্রভাব বিস্তার করে। পুরো এলাকার মানুষ তাদের কাছে জিম্মি। এরা কেউ আওয়ামী লীগ কেউ বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও গরীব মানুষের জায়গা দখলে সবাই এক। কিছুদিন আগে সরকারি ত্রাণ বিতরণ নিয়েও তাদের বিরুদ্ধে জহির প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়েছিল ইলিয়াছ। ইলিয়াছ নিজেকে এলাকায় যুবলীগ নেতা পরিচয় দেন। মূলত অন্যদের ইন্ধনে ঘরের সামনে ইলিয়াছই প্রথমে কুপিয়েছে জহিরকে। পরে রাস্তায় অন্যরা সবাই মিলে অ্যাম্বুলেন্সে দ্বিতীয় দফা হামলা চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।
নিহত জহিরের স্ত্রী নুর আয়েশা ডলি কান্না করতে করতে বলেন, অনেকদিন ধরে তারা আমার স্বামীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিল। তারা তাই করেছে। আমি এখন ছোট ছোট চার সন্তান নিয়ে কিভাবে বাঁচবো। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। খুনীদের ফাঁসি চাই।
এ ব্যাপারে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ রয়েছে।  আমরা লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চমেক মর্গে প্রেরণ করেছি।  ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।

ডিসি/এসআইকে/এমএমবিটি