বাবা-মেয়ের সম্পর্কের এ কেমন রূপ?

মানিক মিয়া-হানোফা।

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
‌‘মানিকের সঙ্গে টাকা-পয়সা লেনদেন নিয়েই তাদের পরিচয় হয়। উচ্চ সুদে মানিকের দেয়া ঋণ পরিশোধ করেন হিরোফা।  হিরোফার পরিচয়ের সুবাদে ওই এলাকার বিভিন্ন নারীদেরও ঋণ দিতো মানিক।  বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে হিরোফা ও মানিক উচ্চ সুদে ওই এলাকায় বিভিন্ন জনের কাছে বিনিয়োগ করতো।  কোনো গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে হিরোফাকে চাপ দিতো মানিক।  এ সময় হিরোফার কাছ থেকে মানিক ব্যাংকের কয়েকটি ফাঁকা চেক নেন।  এদিকে বিভিন্ন এনজিও হিরোফাকে টাকা পরিশোধে চাপ দিতে থাকে।  পরে মানিকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিছু কিছু ঋণ পরিশোধ করে সে।  এভাবেই মানিকের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় হিরোফার।  তাদের পরিচয়ের পর মানিক তার অসুস্থতার কথা বলে চিকিৎসার জন্য হিরোফাকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ যান।  ধর্মের বাবা মানিকের সঙ্গে সরল বিশ্বাসেই যেতে রাজি হন হিরোফা।  ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে দেরি হওয়ায় তারা একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে ওঠেন।  মানিক হঠাৎ ওই কক্ষের দরজা বন্ধ করে হিরোফাকে বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দিতে শুরু করেন।  এ সময় হিরোফার সকল ঋণ পরিশোধ করে একটি বাড়ি বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন।  পরিস্থিতির শিকার হিরোফার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন মানিক।  এরপর থেকে প্রতিনিয়তই হিরোফার সঙ্গে মানিক শারিরিক মেলামেশা করতেন।  এদিকে মানিক তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হিরোফার ঋণ পরিশোধ করেননি।  বরং নিজের প্রভাব খাটিয়ে অন্য এনজিও আর ব্যাংক থেকেও হিরোফাকে ঋণ নিতে বাধা দেন।  এরই মাঝে হিরোফাকে মেয়ে পরিচয় দিয়ে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে তারা চিকিৎসার নামে ভারত গিয়েও একই সঙ্গে থাকেন।  সেখান থেকে ফিরে হিরোফাকে স্বামী লিটনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করে মানিক তার সঙ্গে ঘর করার প্রস্তাব দেন।  এতে রাজি না হওয়ায় ওই ফাঁকা চেক দিয়ে হিরোফার বিরুদ্ধে মামলা করেন মানিক।  বিষয়টি হিরোফা তার পরিবারের লোকজনকে জানালে তারা মানিককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন’।
কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়াকৈর সার্কেল) আল-মামুন।  বাবার পরিচয়ে সম্পর্ক স্থাপন এবং পরে জিম্মি করে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনের এই অনৈতিক সম্পর্কের শুরু ও শেষ- আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

গ্রেফতার সকল আসামি।

শ্রীপুর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক রাজীব কুমার দাস ও মো. আশরাফুল্লাহ্ জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বাবা আনোয়ার হোসেনের অসুস্থতার কথা বলে কৌশলে মানিক মিয়াকে স্থানীয় সলিং মোড়ে ডেকে নেন হিরোফা।  সেখান থেকে একটি অটোরিকশায় করে মানিক মিয়াকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামের হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে নিয়ে যান।  সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম, হিরোফার স্বামী লিটন ও তার বাবা আনোয়ার হোসেন ও ভাই সোহেল মিয়া।  তাদের মধ্যে বেশ আলাপচারিতার পর রাতে রেজাউল ও সোহেল মিলে প্রথমে মানিককে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।  পরে হিরোফা-লিটন মিলে ধারালো চাকু ও দা দিয়ে প্রথমে গলা পরে দুই হাত-পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে বাড়ির পাশের শৌচাগারের গর্তের ভেতরে মানিক মিয়ার মরদেহ ফেলে দেন।  ২/৩ দিন পর মরদেহ পচে সেখান থেকে প্রচুর গন্ধ বের হতে থাকে।  গন্ধ ছড়ালে ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে আনোয়ার হোসেন খবর দেন ভাড়াটে খুনি রেজাউলকে।  রাতের আঁধারে সেই মরদেহটি শৌচাগারের গর্ত থেকে তুলে কিছু দুরের একটি ধানের জমির কাদাযুক্ত মাটিতে পুঁতে রেখে দেন।
১৪/১৫দিন পর শিয়ালে সেই মরদেহের আংশিক অংশ তুলে ফেললে আবারও খুনিরা মরদেহটি সেখান থেকে তুলে নিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে পাশের পুকুরে কাদা চাপা দিয়ে রাখেন।  পরদিন পাশের বাড়ির এক নারী গরুকে গোসল করাতে গিয়ে মরদেহটি ভেসে থাকতে দেখে স্থানীয়দের খবর দেন পরে ২ এপ্রিল দুপুরে শ্রীপুর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করেন।  মরদেহটি পচে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ও আংশিক দেহটি মানুষ না পশুর এমন ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে পুলিশ।  বিভিন্ন পরীক্ষার পর মানুষের মরদেহ নিশ্চিত হওয়ার পর তারা অজ্ঞাত হিসেবে মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
এদিকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানিক মিয়া বাড়ি ফিরে না আসায় তার ছেলে অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান মিলন নিখোঁজের পর দিনই ১২ ফেব্রুয়ারি শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।  এ ডায়েরির সূত্র ধরেই তদন্ত শুরু করে শ্রীপুর থানা পুলিশের একটি টিম।  নিখোঁজের কয়েক দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়ার ছেলের মুঠোফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবি করে একটি ক্ষুদেবার্তা আসে।  সে বার্তায় খুলে দেয় মানিক মিয়া হত্যার মূল রহস্য।
প্রথমে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ক্ষুদেবার্তা প্রেরণকারী হিরোফার ভাই সোহেলকে শ্রীপুর থেকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।  পরে তার দেয়া তথ্য মতে, গত ১৬ মে রাতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক রাজিব কুমার সাহা ও আশরাফুল্লাহ।  পরে সেখান থেকেই হিরোফা-লিটন দম্পতিকে আটক করা হয়।  এছাড়াও গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রাম থেকে হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেন ও একই গ্রামের ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিমকে আটক করা হয়।  আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের খুনিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণে জানা গেছে, মানিক মিয়া ও হিরোফা আক্তারের পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।  এই সর্ম্পকের আড়ালে মানিক মিয়া প্রথমে হিরোফাকে মেয়ের স্বীকৃতি দেন।  পরে বাবা-মেয়ের এই সম্পর্কের মধ্যেই হিরোফা বিভিন্ন প্রয়োজনে মানিক মিয়ার কাছে ফাঁকা ব্যাংক চেক আমানত রেখে বেশ কিছু অংকের টাকা সুদে ধার নেন।  এক সময় মানিক মিয়া এই চেককে অবলম্বন করে হিরোফাকে জিম্মি করে তার সঙ্গে অবৈধ মেলামেশার সম্পর্ক গড়ে তোলেন।  মানিক মিয়া একপর্যায়ে হিরোফাকে স্বামী-সন্তান ছেড়ে তাকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।  মানিকের প্রস্তাবটি হিরোফা তার পরিবারের লোকজনকে অবহিত করেন।  এ নিয়ে সম্পর্কের অবনতি হয় উভয় পরিবারের মধ্যে। পরে ধার নেয়ার সময় আমানত হিসেবে রাখা ব্যাংক চেকে ৫০ লাখ টাকা বসিয়ে মানিক মিয়া ধার নেয়া টাকা উদ্ধারে হিরোফার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন।  এ নিয়ে মানিক মিয়ার সঙ্গে হিরোফার পরিবারের নানামুখী দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।  এই দ্বন্দ্বের জেরেই হিরোফা-লিটন দম্পতি ভিন্ন পথে হাঁটতে থাকেন।  একপর্যায়ে উপায় না পেয়ে মানিক মিয়াকে খুন করে লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেন।  গত ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মানিক মিয়াকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামে হিরোফার বাবার বাড়িতে ডেকে নিয়ে শ্বাসরোধ হত্যা করা হয়।
মানিক মিয়া (৫২) শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের মৃত শাহাজ উদ্দিনের ছেলে।  আর হিরোফা আক্তার (৪০) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের লিটন মিয়া স্ত্রী, তিনি ওই এলাকায় দর্জির কাজ করতেন।  মানিক হত্যায় হিরোফার বাবা আনোয়ার, ভাই সোহেল ও ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম অংশ নেন।  রেজাউলকে ৩০ হাজার টাকায় খুনের চুক্তি করেন হিরোফার বাবা।  আটকের পর তারা সবাই গত রবিবার (১৭ মে) পুলিশের কাছে মানিক মিয়া হত্যার পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন।
শ্রীপুর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান জানান, মানিক মিয়ার সঙ্গে নানামুখী দ্বন্দ্বের কারণে অভিযুক্তরা তাকে হত্যা করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেন।  তারা সকলেই পুলিশের কাছে হত্যার বর্ণনা দিয়ে দোষ স্বীকার করেছেন।  তাদের জবানবন্দির আলোকে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে উদ্ধারকৃত মরদেহের অংশ বিশেষ মানিক মিয়ার।  আর মানিক মিয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের সঙ্গে ওই দেহের ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হবে।  ডিএনএ টেষ্টের ফল হাতে পেলে ওই দেহের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়াকৈর সার্কেল) আল-মামুন জানান, হিরোফা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের রক্ষা করতে প্রথমে অন্য লোকদের ও পরে শুধু নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে তদন্তকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।  কিন্তু পুলিশ বিভিন্ন কৌশলে একের পর এক প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে এবং একাধিক অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ